হানাফি আঙ্গিক ভাবনার ফিক বিষয়ে অন্যতম গুরুত্বপুর্ন বই হল হেদায়া। এটি লেখেন দ্বাদশ শতে প্রখ্যাত বিচারক আলদিনঅলমারঘিনানি (১১৩৫-৯৭)। মুল পাঠ্যটি আরবিতে লেখা হয়। যে সব অঞ্চলে হানাফি মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সে সব অঞ্চলে এই বইটি অবশ্যপাঠ্য হিসেবে গৃহীত হয়ে এসেছে। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই তথ্যটি মাথায় রেখে আইন বইটি ইংরেজিতে অনুবাদের সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। কোম্পানির প্রশাসকদের ইচ্ছা ছিল তারা এমন একটি ইসলামি বিচার বিষয়ক গুরুত্বপুর্ণ বই অনুবাদ করাবে যেটি ইসলামি প্রজাদের বিচারে সহায়ক হবে। বিচারকেরা এক দিকে আরবি বোঝেন না, অন্যদিকে হেদায়া অনুসরণ করা মুসলমানদের প্রথাও তারা জানেন না – তাই কোম্পানি সরকার বইটির ইংরেজি অনুবাদে সচেষ্ট হন।
ওয়ারেন হেস্টিংসের পরিকল্পনা ছিল ব্রিটিশ আইনের সঙ্গে দেশিয় গোষ্ঠীগুলির পারসোনাল আইন মিলিয়ে মিশিয়ে এই বিশাল অনুবাদকর্মটি সম্পাদন করানোর। প্রথমে হেদায়া আরবি থেকে ফার্সিতে অনুবাদ হল, সেখান থেকে ইংরেজিতে অনুদিত হয়। দীর্ঘ মুঘল সময়ের পরে ফারসিতে হেদায়া সেই সময় ছিল না এমনটা ধারণা করা বেশ কষ্টকর, হয়ত এমনও হতে পারে কোম্পানির সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের সে সময়ের ফারসি সংস্করণটি পছন্দ ছিল না। আরবি থেকে ফারসিতে অনুবাদ করেন গুলাম য়েহে। তার সঙ্গে ছিলেন তিন জন মোল্লা তাজ আড্ডেন, মীর মহম্মদ হোসেন এবং মোল্লা শারিত উল্লা। হেদায়ার প্রথম ফারসি সংস্করণের মুখবন্ধে ন্যায় বিচার এবং সঠিক প্রশাসন উপহার দেওয়ার জন্য ওয়ারেন হেস্টিংসের উদ্যমের প্রশংসা করা হয়। অনুবাদে ওয়ারেন হেস্টিংসের পদকে বলা হল নবাব গভর্নর জেনারেল। ফারসির ইংরেজি অনুবাদটি খুব ভাল হয় নি, প্রচুর ভুল থেকে গিয়েছিল। ফারসি সংস্করণে মুল পাঠ এবং তার ব্যখ্যার মধ্যে কোন অন্তর রাখা হয় নি, দুটি মিলেমিশে গিয়েছিল। আধুনিক সময়ের গবেষক সৈয়দ মাহমুদ মুল আরবি হেদায়ার সঙ্গে হ্যামিলটনের ইংরেজি সংস্করণের হেদায়ার বহু পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন।
কোম্পানির হাতে ফারসি হেদায়া এসে পড়লে তারা সেই পাঠ্যটি চার্লস হ্যামিলটনকে অনুবাদের দায়িত্ব দ্যায়। হ্যামিলটন এটি ১৭৯২ সালে অনুবাদ সম্পন্ন করেন। চার খণ্ডে প্রকাশিত হয়। হ্যামিলটনও তাঁর অনুদিত হেদায়ায় ওয়ারেন হেস্টিংসকে উতসর্গ করেন। হ্যামিলটনের এবং তার সঙ্গে ফারসি ভাষায় হেস্টিংসের প্রতি সম্মাননা আমাদের বুঝতে সাহয্য করে ঔপনিবেশিক ভারতের বিচার ব্যবস্থার প্রতি হেস্টিংসের উৎসাহ।
ইংরেজির হেদায়ার গুরুত্ব হল এটি অষ্টাদশ শতকে একমাত্র ইসলামি আইন পুস্তক। ভারতে যেসব আমলা বিচার ব্যবস্থা বিষয়ে চাকরি নিয়ে যেতে উৎসাহী তদের অবশ্যপাঠ্য করা হল ব্রিটেনের কাউন্সিল অব লিগ্যাল এডুকেশনের শিক্ষার্থীদের জন্যে। উনবিংশ শতকে হেদায়া শুধুই একটি রেফারেন্স বই হয়েই থাকল না, বরং উপনিবেশের বিচার ব্যবস্থা বিষয়ে উৎসাহী ছাত্রদের এই বই অবশ্য পাঠ্য পুস্তক হয়ে উঠল। ঔপনিবেশিক উপমহাদেশে অন্যান্য আইনি বইএর তুলনায় হেদায়ার গুরুত্ব এখানেই যে সেটি প্রথম ইসলামি আইনি বই যেটি প্রথম ইংরেজিতে অনুদিত হল। এই প্রবন্ধের দুই পাকিস্তানি লেখক বলছেন যেহেতু উপনিবেশের সময় হ্যামিলটনের হেদায়ার গ্রহণযোগ্যতা প্রায় অপ্রতিরোধ্য ছিল, পাকিস্তান স্বাধীন হবার পরও ঔপনিবেশিক ধারনা মুছে যায় নি, সে সময়েও এই পুস্তকটি প্রায় একই গুরুত্ব অর্জন করে।
হ্যামিলটনের হেদায়ায় যত বিষয় আলোচিত হয়েছে, তত বিষয় ঔপনিবেশিক সময়ে প্রকাশিত হওয়া কোন ইসলামি আইন বইতে সঙ্কলিত হয় নি। আশ্চর্যের বিষয়, এই বইতে উত্তরাধিকারের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই উল্লিখিত হয় নি। মুল সংস্করণে zakat, oaths and vows, slavery, partnership (shirkat), sale, substantive criminal matters such as hudood, procedural matters including procedure of courts and rules of evidence ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে। হয়ত হ্যামিলটনের অনুবাদটি ইসলামি আইন হিসেবে যখন প্রকাশিত হচ্ছে তখন তখন ইসলামি আইন পার্সোনাল আইন, ফৌজদার আইন এবং প্রসিডিউরাল আইন হিসেবে প্রযুক্ত হত। এন্ডারসন বলেছেন উনবিংশ শতকের দ্বিতীয় পাদে যখন ঔপনিবেশিক সরকার সাবসট্যান্সিভ এবং প্রসিডিউর্যাডল আইন প্রণয়ণ করার পর থেকে ইসলামি আইন প্রযুক্ত হত শুধুই ব্যক্তিগত বিষয় বিচার করতে। ১৮৭০ সালে গ্রেডি হ্যামিলটনের হেদায়ার সহ একখণ্ড সটিক সংস্করণ প্রকাশের সময় একটি দীর্ঘ সুচিন্তিত মুখবন্ধ লিখে বলেন তিনি তাঁর ইংরেজি সংস্করণে দাসত্ব বিষয়ে সব ধরণের আইন বাতিল করে দিচ্ছেন। আজ যে হেদায়া আমরা দেখি(লেখকেরা পাকিস্তানের প্রেক্ষিতে বলছেন) সেটি মূলতঃ গ্রেডির সংস্করণ। এটি আজও হ্যামিলটনের হেদায়া হিসেবেই প্রকাশিত হয়ে চলছে।
---
সূত্রঃ Genealogical Analysis of Islamic Law Books Relied on in the Courts of Pakistan - Shahbaz Ahmad Cheema Samee Ozair Khan
---
সূত্রঃ Genealogical Analysis of Islamic Law Books Relied on in the Courts of Pakistan - Shahbaz Ahmad Cheema Samee Ozair Khan
No comments:
Post a Comment