Showing posts with label Monograph. Show all posts
Showing posts with label Monograph. Show all posts

Wednesday, October 2, 2013

বাংলার প্রাচীন লোহা শিল্প৬, Iron & Steel in Medieval Bengal6

একটি ভাঙা মাটির পাত্রের এক পাত্রে কাঠকয়লা, একপাত্রে আকরিক নির্দিষ্ট মাত্রায় মিশিয়ে চুল্লির ভেতরে ফেলা শুরু হয়। হাওয়া দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানিও ক্রমাগত যোগান দেওয়া হতে থাকে। আকরিক মোটামুটি গুলির আকারের কৃস্টালাইন ফ্রাকচারওয়ালা শুদ্ধ হেমাটাইট। এই গুলিআকৃতির লোহাকে বাড়ির বয়স্কা মেয়েরা গুঁড়ো করে চুল্লিতে দেওয়ার উপযোগী করে তলে। টুয়ারের হাওয়া থেকে কার্বন মনোক্সাইড পুড়ে নীল শিখা হয় এবং চুল্লির মুখে সাদা আগুন জ্বলে। টুয়ারের গায়ে লেগেথাকা ভিজে বালুমাটিতে একটি রোগা লাঠি খোঁচানো হয় ঘন্টা দেড়েক পর। টুইয়ারের একটি মুখ দিয়ে কিছু গলিত বর্জ্য পদার্থ বেরিয়ে আসে।  প্রত্যেক আধ ঘণ্টা অন্তর অন্তর এই ভাবে খুঁচিয়ে বর্জ্য বার করা হতে থাকে। এগুলো স্বচ্ছ, কালো, ঠাণ্ডা হওয়ার পর অনেক খণ্ডে ভাগ করা হয়। যতক্ষণ না শেষ কাঠকয়লাটি পুড়ে যাচ্ছে ততখন চুল্লিতে হাওয়া দেওয়া হয়। মোটামুটি ১ মন চারকোলে ২০ সের লোহা আকরিক মেশানো হয়। এইটি প্রক্রিয়াটি মোটামুটি তিন থেকে চারঘন্টা চলে। এবারে টুইয়ার খোলা হয়, বালি সরানো হয়, ইত্যাদি গোটানোর ঘটনা ঘটতে থাকে। চারকোল চুল্লি থেকে বার করা হয়, ঠাণ্ডা করা হয়। এর ভেতর থেকে কাঠের হাতলের লোহার চিমটে দিয়ে লোহার মণ্ড টেনে বার করা হয়। এরপরে এটিকে ঘাসে রেখে হালকা হালকা হাতে পিটিয়ে বাকি বর্জ্যও বের করে দেওয়া হয়। খুব বেশি যাতে পেটানো না হয় তার দিকে নজর রাখা হয়, কেননা লোহা ওজনেই বিক্রি হয়। এই পদ্ধতিতে ৬/৭ সের লোহা পাওয়া যায়। এই কাঁচা লোহা টাকায় ২০ থেকে ২৫ সের পাওয়া যায়।
জিওলজি ইন ইন্ডিয়ার তৃতীয় খণ্ডের ৩৪০ পাতায় বেল বলছেন বীরভূমের বড় ফারনেসে যে পিগ লোহা তৈরি হয় তা পরে ইস্পাতে পরিণত করা হয়। তবে এই তথ্য বিভ্রান্তিকর। কেননা এখনও পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে বীরভুমে ইস্পাত তৈরির কোনও বর্ননা নেই। কিন্তু আমি নিশ্চিত এখানে এক সময় ইস্পাত তৈরি হত। ১৫০০ সাল থেকে বাংলার নানান কাজে যে বিশাল পরিমাণ অস্ত্র প্রয়োজন হয়েছে তার সবই আমদানি করা হয়েছে, এই তথ্য আমি বিশ্বাস করি না। ঐ পত্রিকারই নবম সংখ্যায় ম্যালে দার্জিলং জেলার, কালিম্পঙের ৫ মাইল দক্ষিণ পুর্বের শিখবার গ্রামের কথা লিখছেন, এই অঞ্চলে যে ধরণের নরম লোহা তৈরি হত তা খুকরি এবং বান তৈরির জন্য যথেষ্ট। তবে তার পরিমাণ কিন্তু যথেষ্ট কম। এক সময় যে সাঁওতাল পরগনায় ইস্পাত তৈরি হত তার কথাও সমীক্ষায় উল্লিখিত হচ্ছে, এখন আর বুলেট আটকে দেওয়া সাঁওতালি ইস্পাত তৈরি হয় না।
রাজমহল পাহাড় আর সাঁওতাল পরনায় লোহা তৈরি করেন এখনও কোল সমাজ। ছোটনাগপুরেও কিছু কোল লোহা তৈরি করেন। এরা অনেকটা সাওতালদের সঙ্গে যুক্ত। কেউ কেউ বলেন মুণ্ডা, হো, ভুমিজ কোল অথবা সাঁওতাল প্রায় একই সমাজ বললেও অত্যুক্তি হবে না। সাঁওতালরা এখন আর লোহা তৈরি করেন না এবং তারা লোহা তৈরি করা কোলেদের নিচু চোখে দেখে। ১৮০৭এ ফ্রান্সিস বুকানন এদের নিরুপদ্রব সমাজ বলছেন। তারা শুধুই লোহা তৈরির জন্য কোলদের নিচু নজরে দেখে না সম্প্রদায়গতভাবেই এই বিষয়টি ঘটে তা বলা যাবে না।
তবে ছোটনাগপুর এলাকায় মূল লোহা প্রযুক্তিবিদেরা হলেন আগারিয়া সমাজ। লোহারিরা হিন্দু সমাজে খুবই নিচু স্তরে বাস করে। ওল্ডহ্যাম বলছেন বীরভূমে দুই ধরণের সমাজ লোহাকাম করতেন। এরা দু ধর্মের মানুষ। একটি মুসলমান, অন্যটি হিন্দু। 

বাংলার প্রাচীন লোহা শিল্প৫, Iron & Steel in Medieval Bengal5

এই বিশাল পরিমাণে লোহা উৎপন্ন হওয়ায় ইয়োরোপীয়রা এই জেলার ওপরে অত্যধিক নজর দিতে শুরু করে। ১৮৫২র ওল্ডহ্যামের সমীক্ষার পর মেসার্স ম্যাকে অ্যান্ড কোং ইয়োরোপীয় প্রযুক্তিতে লোহা গলানোর কারখানা তৈরি করে। এই কারখানাটি ২০ বছর ধরে চলে। এবং এর পরে যখন এই কারখানাটি বন্ধ হয়ে যার, তখন দেখাযায় যে এই জেলার দেশিয় পদ্ধতিতে লোহা উৎপাদন ব্যবস্থা পুরোপুরি ধংস হয়ে গিয়েছে। ওল্ডহ্যামের কিছু হাতে আঁকা ছবি মেমোয়ার্স অব জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার অষ্টম খণ্ডে, দ্বিতীয় ভাগের ৮৭ পাতায় প্রকাশিত হয়েছে। এই চুল্লিগুলো ৭-৮ ফুট উঁচু হত। ঘেরে ৫ ফুট। এগুলি অনেকটা ইংরেজি ডি অক্ষরের মত। চ্যাপ্টা দিকটি সামনে থাকে। একটি টুয়ারের মাধ্যমে বাতাস ভরা হতে থাকে। হাপরগুলো অন্যান্য জেলার মতই কিন্তু আকারে বেশ বড়। তাই অনেকে মিলে একসঙ্গে এই হাপরগুলি চালাত।
চুল্লিগুলো গভীর করে বসানো হত। চুল্লিকে ঘিরে একটি প্লাটফর্ম থাকত যেখানে জ্বালানি আর আকরিকের মিশ্রণ রাখা হত। কারিগর এখানে দাঁড়িয়ে এই মিশ্রণ চুল্লিতে দিতে থাকতেন। যে ফোর্জে বারবার তপ্ত করে লোহার পিন্ডকে পিটিয়ে পরিশুদ্ধ করা হত সেটিও বেশ বড়সড় হত। ওল্ডহ্যাম তাকেও চুল্লি বলেছেন, কিন্তু তার আঁকা ছবি থেকে পরিষ্কার যে এগুলো হার্থের পাশে রাখা নানান ধরনে মাপের শুধুই ফোর্জ।
আমি ১৮ এপ্রিল ১৯০৭ সালে দুমকার একটু দূরে কোল সমাজের লোহা তৈরির পদ্ধতি লক্ষ্য করি। ওড়িশা, ছোটনাগপুর, সম্বলপুর বা রাজমহল পাহাড়ে যে ধরণের লোহা গলানোর পদ্ধতি রয়েছে, কোলেদের লোহা গলানো পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে আলাদা। ছোট্ট ঢিপির তলায়, বট গাছের নিচে তারা চুল্লি তৈরি করে। এটি মাটির তৈরি। এবং ব্যবহারের আগে খুব সাবধানে এই চুল্লিটি শোকানো হয়। এটি পুরোপুরি চোঙাকৃতি। উচ্চতায় ৩৪ ইঞ্চি, ঘেরে ২৬ ইঞ্চি নিচে আর ওপরে ১১ ইঞ্চি। হার্থের ভেতরের ঘের ১ ফুট, মাথায় ৫ ইঞ্চি। ছুল্লির পাশে ১ফুটেরমত একটি অর্ধগোলাকৃতি ছিদ্র রয়েছে। এটিতে ইটে ভর দেওয়া টুয়ারের নল প্রবেশ করে। টুইয়ারটির নল দৈর্ঘে ৭ ইঞ্চি আর ঘেরে  ১ ইঞ্চি, অনেকটা শঙ্কু আকৃতির। টুইয়ার জড়িয়ে থাকে ভিজে বালু মাটি। হাপর তৈরি হয় ১৬ ইঞ্চির ঘেরের আর ৫ ইঞ্চি উচ্চতার চোঙার মত কাঠ দিয়ে। এর ভেতরটি কুরে ফাঁকা করা। মুখে একটি ছাগলের চামড়া বসানো। কাঠের চোঙার পাশে ৩ ফুটের একটি বাঁশের নল জোড়া থাকে। এর এক দিকে একটি লোহা নজ়ল হিসেবে লাগানো হয়। এই ধরনের দুটি হাপর তৈরি করা হয়। এই দুটি হাপরের লোহার নজ়ল টুয়ারের মধ্যে ঢোকানো হয়। দুটি হাপরকে খুব কাছাকাছি বসানো হয় যাতে এই দুটি বাঁশের নল টুয়ারের সমান্তরাল থাকে। চুল্লির বাইরের দিকের নিচ থেকে দুটি বাঁশের বাঁখারি আর্ধ গোলাকৃতি হয়ে গিয়ে দুটি হাপরের ওপরে রাখা হয় এবং সেটির সঙ্গে একটি ফিতে জুড়ে দেওয়াহয় হাপরের সঙ্গে।  একজন এবারে দুটি হাপরের ওপরে দাঁড়িয়ে পর্যায়ক্রমে দু পায়ে সে দুটিকে চালাতে থাকে। চুল্লিটিতে শাল কাঠের কাঠকয়লা(মাটি চাপাদিয়ে শাল কাঠ পুড়িয়ে তৈরি হয়) জ্বালানি সিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটিতে আগুন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ক্রমাগত হাওয়া দেওয়া শুরু হয়। এই সময় চুল্লিতে একটি সিন্দুর লাল ঢ্যারা লাগানো হয়। হয়ত আশীর্বাদ চাওয়ার জন্য। 

বাংলার প্রাচীন লোহা শিল্প৪, Iron & Steel in Medieval Bengal4

লোহা ইস্পাতের দেশজ প্রযুক্তি
বাংলায় এখন দেশজ প্রযুক্তিতে লোহা ইস্পাত তৈরি হয়না বললেই চলে। উনবিংশ শতের আগে কি ধরণের প্রযুক্তি ছিল তার কোনও নিদর্শন পাওয়া যায় না। ডঃ ফ্রান্সিস বুকাননের, দ্য হিস্টোরি, অ্যান্টিকুইটিজ়, টোপোগ্রাফি অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্স অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া, ১৮০০৭-১৮১৩য় প্রথম বর্ণনা পাওয়া যায়। ভাগলপুরে কোল সমাজ কি ধরণের প্রক্রিয়ায় লোহা উৎপাদন করতেন তার বিশদ বর্ননা এই সমীক্ষায় করেছেন বুকানন। এই শতেরই চার এবং পাঁচের দশকে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে এধরনে অনেকগুলি প্রবন্ধ প্রকাশ হয়। ১৮৪৯এ কিটো, ওড়িশার তালচের, উঙ্গুল এবং ঢেঙ্কানলের লোহা তৈরির বর্ননা দেন(জার্নাল, ৮ খন্ড, ১৪৪ পৃ); ব্যাবিংটন ১৮৪৩ সালে সম্বলপুরের কুটারবাগা খনি থেকে একটি চুল্লির নমুনা এশিয়াটিক সোসাইটিতে পাঠান(জার্নাল, ১২ খন্ড, ১৬৪পৃ), ওয়েলবি জ্যাক্সন ১৮৪৫এ বীরভূমের লোহা গলানোর একটি ছোট বর্ননা দেন (জার্নাল, ১৩ খন্ড, ৭৫৪ পৃ), রাজমহল পাহাড়ের লোহা তৈরি নিয়ে ডঃ ওল্ডহ্যাম লেখান(জার্নাল, ২৩ খন্ড, ২৭৯)। এই সময় কোম্পানির কোর্ট অব ডিরেক্টর্স এই প্রদেশের খনিজ নিয়ে কিছু প্রশ্ন পাঠান। ওল্ডহ্যাম এ সময় বীরভুমের খনিজ সম্পদ নিয়ে একটি বিস্তৃত সমীক্ষা(সিলেক্সন্স ফ্রম দ্য রেকর্ডস অব দ্য বেঙ্গল গভর্ন্মেন্ট, সপ্তম খন্ড, ১৮৫৩) তৈরি করেন। সম্বলপুরের লোহা শিল্প নিয়েও আরও একটি সমীক্ষা(ডঃ জে শর্ট - সমীক্ষা(সিলেক্সন্স ফ্রম দ্য রেকর্ডস অব দ্য বেঙ্গল গভর্ন্মেন্ট, ত্রয়োবিংশতি খন্ড, ১৮৫৫) পেশ করা হয়।
এই সমীক্ষা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার হয় যে উনবিংশ শতকে ওড়িশা, সম্বলপুর এবং ভাগলপুরে প্রায় এক ধরণের লোহা গলানোর প্রযুক্তি ব্যবহার হত। চুল্লিগুলি মাটির তৈরি, তিন থেকে চার ফুট উঁচু, মাথার দিকে ঘেরে আড়াই ফুট এবং নীচের দিকে একটু বেশী চওড়া। মাথার দিকে ভেতরের ঘের করেক ইঞ্চি আর নিচের দিকে এক ফুটের কাছাকাছি। একটি মাটির পাইপ টুইয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং এর মাধ্যমে দুটি হাপরের ওপর একজন দাঁড়িয়ে পাদিয়ে পর্যায়ক্রমে হাপরকে চালিয়ে চুল্লিয়ে হাওয়া ঢোকানোর কাজ করতেন। চুল্লিতে চারকোলের সঙ্গে লোহা আকরিক মিশ্রন জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হত। গলিত লোহা চুল্লির নিচে এসে জমা হত। একে বের করে এনে সাধারণ কামারশালে বহুবার ঠাণ্ডা গরম করে পিটিয়ে শুদ্ধ লোহা আর লোহার নানান যন্ত্রপাতি তৈরি করা হত। শুধু ভাগলপুর জেলায় ৩০০ টনের মত লোহা তৈরি হত। কিন্তু অন্য দুটি জায়গা, ওড়িশা, সম্বলপুরের উৎপাদন পরিমানের বর্ননা দেওয়া হয় নি। বীরভূমের লোহা গলানোর প্রায় একই পদ্ধতি। পার্থক্য হল এটির চুল্লির আকার বেশ বড়। প্রত্যেক চুল্লি ২৫ মনের মত লোহা তৈরি করতে পারত। ডঃ ওল্ডহ্যাম বলছেন প্রত্যেক বছর ২৩৮০ টনের মত লোহা তৈরি করত বীরভূমের চুল্লিগুলো।

বাংলার প্রাচীন লোহা শিল্প৩, Iron & Steel in Medieval Bengal3

বাংলায় মুসলিম সাম্রাজ্যের শুরু থেকেই লোহা এবং ইস্পাত তৈরি এবং ব্যবসার নানান সুযোগ তৈরি হতে থাকে। বাংলার লোহা প্রযুক্তিবিদেরা বিদেশী কারিগরদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে লোহা শিল্পে পারদর্শী হয়ে ওঠে। বাংলায় লোহা শিল্প মুস্লিমদের দ্বারা এতই প্রভাবিত যে, বাংলার প্রাচীন অস্ত্র শিল্পের বিশিষ্টতা বর্ননা করা এখন প্রায় অসম্ভব বললেও অত্যুক্তি হয় না। বাংলার পাটনা, মুঙ্গের, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ এবং বর্ধমানে যে ধরণের অস্ত্র তৈরি হয় তাঁর সঙ্গে পারস্যের, আরবের এবং পাঞ্জাবের অস্ত্রের বিন্দুমাত্র কোনও পার্থক্য নেই। মুসলিম সাম্রাজ্য যে সব ধরণের শস্ত্র তৈরির উদ্যম নিয়েছিল সে তথ্য আজ যথেষ্ট পুরনো। আকবর নিজে উচ্চশ্রেণীর ধাতুবিদ ছিলেন এবং যেকোনো অস্ত্র তৈরিতে পারদর্শী ছিলেন। ইয়োরোপের প্রখ্যাত ধাতু এবং অস্ত্রবিদেরা আকবরের সভার এসে নিজেদের হূনর জাহির করতেন এবং আকবর তাদেরকে কাজ করার সুযোগও দিতেন।আকবর ছোট ছোট অস্ত্রের প্রতি নজর দিয়েছিলেন এবং আকবরের সময় কামান ব্রাসেই ঢালাই করা হত।
পঞ্চদশ আর ষোড়শ শতে বাংলায় কি ধরণের শস্ত্র তৈরি হত তার কোনও নিদর্শন আমরা এখন আর পাই না। মুর্শিদাবাদে জাহানকোষা নামে একটি বিশাল কামান পড়ে রয়েছে। এতে একটি ছাপ রয়েছে, যা থেকে বোঝাযায় এটি জাহাঙ্গীরনগরে, আজকের ঢাকায় তৈরি হয়েছে। এটি তৈরি করেছেন জনার্দন কর্মকার, শেরে মহম্মদের নজরদারিতে এবং সে সময় এটির কারনিক ছিলেন হরবল্লভ দাস। এটি ১১ জুলুস বছরের জামাদিসানি মাসে অর্থাৎ ১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয়। কামানে আরও একটি ছাপ রয়েছে, যার থেকে বোঝাযায় এই কামান তৈরিতে আটটি ধাতু(অষ্টধাতু) – সোনা, রূপা, তামা, দস্তা লেড, জিঙ্ক, পারদ, লোহা আর টিন ব্যবহার হয়েছে। তবে খালি চোখে দেখে মনে হচ্ছে এটি মুলতঃ লোহা দিয়েই তৈরি। ধাতুতে জঙের চিহ্নমাত্র নেই, যা তার বয়স অনুযায়ী আশ্চর্য জাগায়। এই ধাতুর ভৌত ও রাসায়নিক পরীক্ষা নানান ধরণের প্রশ্নের সমাধান করতে পারে – বিশেষ করে তার তৈরির পদ্ধতিটি। কামানের চোঙায় খাঁজকাটার(রিব-লাইক মার্কিং) দাগ রয়েছে। এবং বাচ্চাওয়ালি কামান তৈরিতে যে ধরণের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, এটি তৈরিতে প্রায় একই ধরণের প্রযুক্তি ব্যবহার হয়েছে। আধুনিক কালে যেমন আমরা বড় কামান তৈরি করি ঠিক সেই ভাবেই দুটো বা তিনটে টিউব জুড়ে জুড়ে কামানের নলটি তৈরি হয়েছে। কামানের বাইরের অলঙ্করণ অবশ্যই রট লোহায় করা হয়েছে। এবং এই অলঙ্করন অনেকটা ফ্লোরেন্স বা মধ্যপ্রাচ্যের ধাঁচের। ‘কামানটির দৈর্ঘ সাড়ে সতের ফুট, টাচহোল এন্ড গার্থ পর্যন্ত ৫ ফুট। টাচহোল বেধ দেড় ইঞ্চি। মুখটি(অরিফিস) ছয় ইঞ্চি। এটির ওজন ২১২ মন এবং এটি থেকে গোলা ছুঁড়তে ২৮ সের বারুদ প্রয়োজন হয়।
তবে অষ্টাদশ শতকের নানান ধরণের অস্ত্র শস্ত্র দেখা যায়। বর্ধমানের মহারাজা প্রত্যেকটা শস্ত্রের ইতিহাস তৈরি করেছেন। বর্ধমান থেকে আট কিমি অদূরে কামারপাড়ায় বহু কামার থাকেন যারা রাজার জন্য অস্ত্র তৈরি করেন। মহারাজার একটি তরোয়ালের গল্প বলা যাক- কামারপাড়ার এক কামার ১৭০০ সালে জঙ্গী রাজা চিত্র সেন রায়ের বাবাকে একটি তরোয়াল বিক্রি করতে আসেন অতি উচ্চ দামে। রাজার সভাসদেরা তাকে উপহাস এবং লাঞ্ছনা করে তাড়িয়ে দেয়। চলে যেতে যেতে সে দেউড়ির সামনে একটি গাছ এমনভাবে কেটে দেয় যে সেই কাটাটি বোঝা যার না। ক্রমশঃ গাছটি শুকিয়ে যেতে থাকলে রাজার নজর পড়ে। তিনি তদন্ত করে বুঝতে পারেন কি ঘটনা ঘটেছে। তখন রাজা সেই কামারকে ডাকিয়ে এনে তারই বরাদ্দ দামে সেই তরোয়ালটি কিনে নেন। ১৭৬১তে ক্যাপ্তেন মার্টিন হোয়াইটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মহারাজা ত্রিলোকচাঁদ বাহাদুর যে ম্যাচলক বন্দুকগুলি ব্যবহার করেছিলেন, সেগুলি এখনও সেই প্রাসাদে রয়েছে। নানান ধরণের যন্ত্রপাতিও রয়েছে যা সেগুলো সারাতে কাজে লাগে। এদের মধ্যে তিনটি হল বিচ্ছু, বিগলি আর বার্ছা।

মুর্শিদাবাদের মহারাজার অস্ত্রগুলি পাটনায় তৈরি। মুঙ্গের বন্দুকের জন্য বিখ্যাত। কামারপাড়ার ম্যাচ লকের মত করে মুঙ্গেরের বন্দুকগুলো তৈরি হত। শতাব্দীর শেষের দিকে ব্রিটিশদেরমত করে মুঙ্গেরে বন্দুক তৈরি হতে থাকে। ভাগলপুরের একটি তরোয়াল তার ধারের দিকে কাজের জন্য বিখ্যাত ছিল। মুর্শিদাবাদের অপরাধীদের হত্যার জন্য তৈরি তরোয়ালের(টেগা বার্ডওয়ানি) আকৃতি দেখার মত। আমাদের ধারণা, মুর্শিদাবাদের কামারেরা বর্ধমানের এই গ্রাম থেকে যাওয়া। এই সময়ের বাংলার অস্ত্রের চরিত্র হল ঝুব সাধারণ আকারের এনং তাতে অলঙ্করনের অভাব। তবে মুর্শিদাবাদের কিছু অস্ত্র রয়েছে যেগুলিতে বাংলার নিজস্বতার ঝলক দেখা যায়। 

বাংলার প্রাচীন লোহা শিল্প২, Iron & Steel in Medieval Bengal2

এ প্রসঙ্গে মুর্শিদাবাদের বাচ্চাওয়ালি কামানের কথা আমরা আলোচনা করতে পারি। এই কামানটি ননাব বাহাদুরের প্রাসাদ এবং ইমামবাড়ার মধ্যের মাঠে দুটি স্তম্ভের ওপর শোয়ানো রয়েছে। মসনদ অব মুর্শিদাবাদের লেখক পি সি মজুমদার(১৯০৫) বলছেন, এই কামানটি গৌড়ের শাসক চতুর্দশ এবং পঞ্চদশ শতকের মধ্যে কোনও এক সময়ে তৈরি করিয়ে ছিলেন। সেই পুস্তক থেকে কামানটির বর্ননা তুলে দেওয়া গেল, ‘...কন্সিস্টিং অব টু পিসেস অব ডিফারেন্ট ডায়ামেটার্স। দ্য স্মলার পর্সান, হুইচ ইজ দ্য চেম্বার্স, ইজ ৩ ফিট অ্যান্ড ৭ ইঞ্চেস লং উইথ আ গার্থ অব ৪ ফিট অ্যান্ড ৪ ইঞ্চেস; অ্যান্ড দ্য লার্জার পোর্সান, নেমলি দ্য ব্যারেল, ইজ ১১ ফিট অ্যান্ড ৬ ইঞ্চেস লং উইথ আ গার্থ অ্যাট দ্য মাজ়ল অব ৭ ফিট অ্যান্ড ৯ ইঞ্চেস। দ্য ডায়ামেটার অব দ্য বোর অ্যাট দ্য মাজ়্‌ল অব ১ ফুট অ্যান্ড ৭ ইঞ্চেস। দ্য টাচ হোল হ্যাজ় বিন প্লাগড উইথ মেল্টেড আয়রন। ইলেভেন রিংস বাইন্ড দ্য রট আয়রন বারেল, দ্য ইনার সার্ফেস অব হুইচ বিয়ার্স অ্যামপ্‌ল এভিডেন্স অফ দ্য গান্স গ্রেট অ্যান্টিকুইটি। দ্য রিম সাউন্ড দ্য মঅ্যাল ইজ় অরনামেন্টেড উইথ পেটালস, হোয়াইল ওয়ান অব দ্য রিংস রিজেমব্‌লসআ স্ট্রিং অব বিডস। অন দ্য আপার হাফ অব দ্য ব্যারেল সার্ফেস, নিয়ার দ্য মাজ়ল, ফর্টিন লাইন্স, সেভেন অন ইচ সাইড, ইনলেড উইথ ব্রাস। এইট স্মলার রিংস আর আটাচড অ্যাট ভেরিয়াস পয়েন্টস। দ্য ব্রিচ প্লাগ ইজ ড্রিভন আন্টিল ইতস ক্যাম্ফার্ড এন্ড ডোভটেলস অ্যান্ড ফিটস টাইটলি ইন্টু দ্য চেমবার্স অব দ্য ব্যারেল, হুইচ আর টায়েড টুগেদার উইথ দ্য রিংস আটাচড টু ইচ।’
এই কামানটি প্রযুক্তিক দিক থেকে একটি অত্যাশ্চর্য বস্তুবিশেষ। আমার জ্ঞান বলে এটি আধুনিক কালের আগে তৈরি একটি মাত্র কামান যেটি ব্রিচ লোডেড কামান। ১৭৬০ পর্যন্ত ব্রিটিশরা মাজ়ল লোড কামান ব্যবহার করত। আমি মোটেই বুঝতে পারছি না, কিভাবে ব্রিচ ব্যারেল না ফাটিয়ে কামান থেকে গোলা ছোঁড়া হত। কামানটি তৈরিটি খুব একটি উচুদরের কাজ নয়। কিভাবে তৈরি হয়েছে তা, কামানের ধাতুর পরীক্ষা না করে বলা যাবে না। মুর্শিদাবাদেরই জাহানকোষায় যে ধরণের রিবেরমত(টান্সভার্স মার্কিং) দাগ রয়েছে, সেই ধরণের দাগও বাচ্চাওয়ালিতে রয়েছে। মুঙ্গেরে যেভাবে ছোট ছোট বন্দুক তৈরি করা হয়, সেই ভাবেই হয়ত রট আয়রনের পাতগুলিকে গোল করে বেঁকিয়ে পরপর রেখে ড্রিল করে দেওয়া হয়েছে। কামানের চোঙার(ব্যারেল) দুপাশে দুটি আশ্চর্য লাইন রয়েছে। আমার ধারণা প্রথমে ব্যারেলের দুটি অর্ধ ঢালাই করে এই লাইন ধরে দুটিকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
রাজেন্দ্রলাল মিত্র বলছেন বংলা সুবার ওড়িশার মেয়েরা যে খারু পরে সেটি অবশ্যই লোহার তৈরি। এ ছাড়াও তিনি বলছেন কালিকা পুরাণে বলা হয়েছে পিট রোগ(জন্ডিস), অ্যানাসার্কা এবং রক্তাল্পতা (এ্যানিমিয়া) সারাতে লোহার বাসন ব্যবহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 

বাংলার প্রাচীন লোহা শিল্প১, Iron & Steel in Medieval Bengal1

(ভূমিকা - প্রাচীন বাংলায় লোহা তৈরির ইতিহাস নিয়ে খুব একটা কাজ হয় নি বললেই চলে। ১৯০৭ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত এই মোনোগ্রাফটি সেই কাজের শূন্যস্থান অনেকটা পূরণ করেছে। তবে পাঠকদের মনে রাখতে হবে, লেখক যে বাংলার কথা বলছেন সেটি অবশ্যই ব্রিটিশ বাংলা অর্থে বাংলা সুবা। এই বইটি থেকে আমরা নিজেদের জন্য প্রযোজনীয় অধ্যায় বেছে নিয়েছি। সেই সঙ্গে সেই অধ্যায়গুলোর সব তথ্যই যে আমরা অনুবাদ করেছি তাও নয়। সম্পাদকেদের যতটুকু মনে হয়েছে, এই সংখ্যায় যতটুকু তথ্য প্রয়োজনীয় ততটুকু তথ্যই ব্যবহার করা গিয়েছে। আমাদের এই খন্ডে এই বইটি দুটি কাজ সম্পন্ন করছে। প্রথমতঃ এক নজরে উৎসুক পাঠকের জন্য এটি বাংলা সুবার লোহা, ইস্পাত শিল্পের ইতিহাসের একটি বিহঙ্গ দৃষ্টি তৈরি করে দেয়। দ্বিতীয়তঃ বাংলার গ্রামের কামারশালগুলো নিয়েও এটি বিশদে আলোচনা করেছে। আমরা লেখকের সেই প্রতিবেদন টুকুও কামারশালের ছবি-প্রতিবেদনের বর্ননায় ব্যবহার করেছি। এই বইএর শেষে অনেকগুলি ছবি এবং হাতে আঁকা চিত্র জোড়া রয়েছে।)


১৫০ খৃস্টপুর্বাব্দ থেকে ৪০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তৈরি উদয়গিরি(১৫০ খৃস্টপুর্বাব্দ), বুদ্ধগয়া(১০০ খৃস্টপুর্বাব্দ – ১০০ খৃস্টাব্দ) বা অমরাবতী(৩০০ - ৪০০ খৃস্টাব্দ ) মন্দিরগুলোর প্রচুর পাথর খোদাই মুর্তি দেখতে পাই যাদের হাতে নানান ধরণের লোহার অস্ত্র রয়েছে। ...৬০০ খৃস্টাব্দে তৈরি ভুবনেশ্বর এবং ১২৩৭ খৃস্টাব্দের কোণার্ক মন্দির এখনও পর্যন্ত অপরূপভাবে, বিকৃত না হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র অ্যান্টিকুইটিজ় অব ওড়িশায় মন্দিরগুলির বিশদ বর্ননা দিয়েছেন। এই মন্দিরগুলির ভাষ্কর্যে পাওয়া শস্ত্রগুলির সঙ্গে অন্যান্য দেশের শস্ত্রের তুলনা টানা একটি আনন্দদায়ক কাজ হতে পারে। ...তবে আমার মনে হয় ভাষ্কর্যগুলো থেকেও আরও গুরুত্বপুর্ন বিষয় রয়েছে।

কোণার্ক(ব্ল্যাক প্যাগোডা) তৈরি করতে বিশাল বিশাল লোহার স্তম্ভ ব্যবহার হয়েছে। যদিও ফার্গুসন এটিকে নবম শতের মন্দির বলছেন, পরে স্টার্লিংএর সুত্রে জানা গিয়ছে এটি তৈরির নির্দিষ্ট তারিখ। মন্দিরের সামনে, পুর্ব দিকে, বিশাল বিশাল পাথরকে ধরে রেখেছে ২৩ ফুট সাড়ে এগারো ইঞ্চির মোটা একটি লোহার বার(কড়ি)। মন্দিরের জগমোহনের ছাদটিকে ধরে রাখতেও ব্যবহার হয়েছে লোহার কড়ি। ফার্গুসন, হিস্টোরি অফ আর্কিটেকচারের ৪২৮ পাতায় বলছেন, ‘ইন্টার্নালি দ্য চেম্বার্স ইজ সিঙ্গুলার্লি প্লেন, বাট প্রেজেনটস সাম কন্সট্রাক্টিভ পিকিউলিয়ারিটিজ ওয়ার্থি অব এ্যাটেনসন। অন দ্য ফ্লোর ইট ইজ আবাউট ৪০ ফিট স্কোয়ার অ্যান্ড দ্য ওয়াল সাইজ প্লেন টু অ্যাবাউট দ্য সেম হাইট। হিয়ার ইট বিগিনস টু ব্রাকেট ইনওয়ার্ডস, টিল ইট কন্ট্রাক্টস টু অ্যাবাউট ২০ ফিট, হয়ার ইট ওয়াজ় সিইল্ড(ceiled) উইথ আ ফ্ল্যাট স্টোন রুফ, সাপর্টেড বাই রট আয়রন বিমস ...শোইং আ নলেজ় অব দ্য প্রোপার্টিজ অ্যান্ড স্ট্রেংথ অব দ্য মেটিরিয়াল দ্যাট ইজ রিমার্কেব্‌ল ইন আ পিপ্‌ল হু আর নাউ সো আটার্লি ইনক্যাপেব্‌ল অব ফোর্জিং সাচ মাসেস। দ্য এমপ্লয়মেন্ট অব দিজ় বিমস হেয়ার ইজ আ মিস্টিরি। দে ওয়ার নট নিড ফর স্ট্রেংথ, অ্যাজ দ্য বিল্ডিং ইজ় স্টিল ফার্ম আফটার দে হ্যাভ ফলেন, সো এক্সপেন্সিভ আ ফলস সিলিং ওয়াজ নট ওয়ান্টেড আরকিটেকচারিলি টু রুফ সো প্লেন আ চেম্বার। ইট ডিমস টু বি অনলি অ্যানাদার ইন্সট্যান্স অব দ্য প্রোফিউসন অব লেবার হুইচ দ্য হিন্দুজ় লাভড টু ল্যাভিশ অন দ্য টেম্প্‌লস অফ দেয়ার গডস।’ ...আমার মনে হয় এই লোহার কড়িটি নিয়ে আমাদের বিশদে আলোচনা এবং পরীক্ষা করা প্রয়োজন রয়েছে। আমি জানিনা, কোন যুক্তিতে ফার্গুসন এটিকে রট আয়রন বললেন, কেননা এই লোহার কোনও অংশ রাসায়নিকবা ভৌত পরীক্ষার জন্য নেওয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই। মনে রাখা দরকার দিল্লির প্রখ্যাত লোহার স্তম্ভ, হয়ত এই কড়ির বয়সী বা তুলনায় আরও অনেক পুরোনো হতে পারে। 


আয়রন অ্যান্ড স্টিল ওয়ার্ক ইন দ্য প্রভিন্স অব বেঙ্গল - আ মোনোগ্রাফ, ই আর ওয়াটসন, ১৯০৭, Iron & Steel Works in the province ob Bengal  - a monograph, E R Watson, 1907 থেকে