Showing posts with label মহাস্থানগড়. Show all posts
Showing posts with label মহাস্থানগড়. Show all posts

Thursday, December 7, 2017

উপনিবেশপুর্ব বাংলা - বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য২

রণবীর চক্রবর্তী

সাম্প্রতিককালের দক্ষিণ ২৪ পরগণা এবং মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকেতুগড় এবং তাম্রলিপ্তির প্রত্নতাত্ত্বিক উতখননে এ বাদদে অনেক তথ্য পাচ্ছি। এই অঞ্চলে প্রাপ্ত পোড়ামাটির শিলালিপি এবং সিলগুলিতে খরোষ্ঠি এবং খরোষ্ঠী-ব্রাহ্মির মিশ্র লিপির যে কার্বন-তারিখ পাওয়া গিয়েছে, তার সময় নির্ণিত হয়েছে প্রথম খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে চতুর্থ শতক পর্যন্ত। বিভিন্ন সিলে পাওয়া গিয়েছে মাস্তুল তোলা জাহাজ, ধান্যশীর্ষে আর ফসল শীর্ষনালিকার নানান ছাপ, বিভিন্ন শস্য ছাপওয়ালা শস্য বহনের পাত্রের(শস্যাধার)ও ছাপ পাওয়া গিয়েছে। ব্যবসায়ীরা খাদ্য(হয়ত ধান/চাল) ব্যবসা করে ধনী হয়েছেন তার উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। এই সময়ের বাংলা যে বিপুল শস্য উৎপাদন আর আন্তঃরাজ্য এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে রপ্তানি করত, এগুলি তার প্রত্যক্ষ উদাহরণ। অনেক পরে চতুর্দশ শতকের ইবন বতুতা এবং পঞ্চদশ শতকে মাহুয়ানের লেখাতেও বাংলার ধান মালদ্বীপে রপ্তানির বিনিময়ে কড়ি ব্যবসার উল্লেখ পাচ্ছি।
এই গুরুত্বপূর্ণ শস্যের পাশাপাশি উত্তরবঙ্গ, পুণ্ড্রবর্ধনে আখ(ইক্ষু) চাষের উদাহরণ পাচ্ছি, সেই আখের প্রজাতির নাম কিন্তু এলাকার নামে - পুণ্ডু আখ। এটাও আমরা প্রাসঙ্গিকভাবে ভেবে নিতে পারি, চালের মতই বাংলার আখের পণ্যের বিপুল চাহিদা বাংলার বাইরে এবং আন্তর্জাতিক স্তরে ছিল, যেটা আদতে বাংলার লালা ও সাদা চিনি(এবং গুড় – এটা লেখক বলেন নি – গৌড়=গুড় এটাও মনে রাখা দরকার)।
দক্ষিণের গাঙ্গে বা গঙ্গে দেশ বা গাঙ্গেয় বদ্বীপের নিম্নাংশের উল্লেখ পাচ্ছি প্রথম শতাব্দের দ্বিতীয় অংশে লিখিত পেরিপ্লাস অব ইরাথ্রিয়ান সি নামক গ্রন্থে। এই বইতে আমরা বাংলার বৈদেশিক বাণিজ্য শৃঙ্খলে বেশ কিছু পণ্যের অমেয় উল্লেখ পাচ্ছি যেমন মালাবাথরুম(সং> তামলপত্র, বাং>তেজপাতা), নার্দ(সং>নালদ, নারদ হয়ত Nardostachys grandiflora) এক ধরণের বিশেষ গন্ধ তেল। পেরিপ্লাস বলছে এই ধনীভোগ্য পণ্যগুলির বিপুল চাহিদা ছিল রোমের অভিজাতদের জীবনধারণে। একই ধরণের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে দ্বিতীয় শতকে লিখিত একটি ঋণ-চুক্তি বিষয়ের ভুর্জপত্রে। এই সূত্র আমাদের জানাচ্ছে গাঙ্গেয় নার্দ বিপুল পরিমানে মালাবার উপকূলের মাজুরিস বন্দরে(আজকের কেরলের ক্রাঙ্গানোরের কাছে) হার্মোপোলন নামক জাহাজে ভর্তি করে সেটি আলেকজান্দ্রিয়ায় রওনা হয়ে যাবে। যদিও পেরিপ্লাস বলছে তেজপাতা আর নার্দ বাংলার পণ্য, আদতে এগুলি মূলত উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলো থেকে চাষ এবং প্রক্রিয়া জত হয়ে বাংলার উপকূলে রপ্তানির জন্য আসত। এই ধনীভোগ্য পণ্য উপকূল সমুদ্রপথ দিয়ে রপ্তানির জন্য মালাবারে পাঠানো হত। সেখান থেকে চলে যেত ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায়। ফলে আমরা বলতে পারি যে সব ট্রানজিট দ্রব্য বাংলার মধ্যে দিয়ে পুণঃরপ্তানি হত সেগুলির মধ্যে এই দুটি অন্যতম।
ঠিক একই গঙ্গে অঞ্চলের উৎপন্ন দামি ও সূক্ষ্ম মসলিনের উল্লেখ আমরা পেরিপ্লাসে বিপুলভাবে পাচ্ছি। এই পণ্যটি বাংলার উপকূল দিয়ে বিপুল সংখ্যায় বিদেশে যেত। এছাড়াও চিনা রেশমের লাছা, সুতো এবং চিনাংশুক গঙ্গে এলাকা হয়ে দ্রাবিড় অঞ্চলে যেত। চৈনিক রেশম স্থানীয় উৎপাদন মসলিনের মতই অত্যন্ত দামি পণ্য এবং ধনীভোগ্য এবং এটাও বাংলার অন্যতম ট্রানজিট পণ্য হিসেবে গণ্য হত। কিন্তু বাংলার তাঁতের সুখ্যাতি আমরা পাচ্ছি তৃতীয় খ্রিষ্টপূর্বে লিখত অর্থশাস্ত্রে। (তার আগে সে রকম উল্লেখ পাচ্ছি না) কিন্তু তারপর থেকে বিভিন্ন সূত্রে আমরা দেখছি বাংলার তাঁতিদের সুখ্যাতির নানান বর্ণনা নবম থেকে চতুর্দশ শতকে লিখিত আরবি আর পার্সি, চিনা লেখক, মার্কোপোলোর(ত্রয়োদশ শতে) মত লেখকদের নানান উল্লেখে। সক্কলে যদিও বাংলায় আসেন নি, কিন্তু বাংলার তাঁতের সুখ্যাতি তারা তাঁতের উৎপাদন, তার ব্যবসার সঙ্গে জুড়ে থাকা মানুষজনের থেকে সংগ্রহ করেছেন। ১২২৫ সালে চিনা আধিকারিক, চাউ জু কুয়া, পোং-কিয়েলো আর্থাত বাংলার(ভাঙ্গালা) সুতির(তৌলো) সূক্ষ্মবস্ত্রের সুখ্যাত করেছেন।
অষ্টম শতকের পর থেকে বাংলায় সুপারি(গুবাক) এবং পানের(বরজিক শব্দ পাচ্ছি পানের উৎপাদক, বিক্রেতা সূত্রে) উল্লেখ পাচ্ছি। এই সময়েই বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় পাওয়া শিলা/তাম্রলেখতে নারকেল গাছের উল্লেখ পাচ্ছি – এটারও হয়ত ব্যবসা হত। নবম এবং ত্রয়োদশ শতের তাম্রশাসনে খাদ্যে গুরুত্বপূর্ণতম উপাদান নুনের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে, বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায়।
নবম থেকে ত্রয়োদশ শতকের আরব সূত্র থেকে জানতে পারি বাংলা। বিশ্ববাণিজ্যে অসাধারন কাঠের সূত্র ছিল। আরব লেখকদের লেখায় উল্লিখিত সমন্দর বা সুদকাওয়ান(আজকের চট্টগ্রামের কাছাকাছি) অঞ্চলে কামারুণি নামক কাঠের উল্লেখ করেছেন, যা মুলতানি কাঠের পরেই বাণিজ্য ক্ষেত্রে গণ্য এবং দামি হয়। এটি কামারুণ বা কামারুন এলাকার বনজ উৎপাদন। এই কাঠ অসমের জঙ্গল থেকে মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে আনা হত। আরবি আর পারসি সূত্রে গণ্ডারের শিং উক্ত বন্দর থেকে রপ্তানির উল্লেখ পাচ্ছি। এটি আরেকটি বিলাস দ্রব্য। এবং সেটি অসম সূত্রেই চট্টগ্রামের বন্দরে আসত।

উপনিবেশ পূর্ব বাংলা - বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য১

রণবীর চক্রবর্তী

বাংলা সুদূর অতীত থেকেই এশিয় বাংলা-বাণিজ্যের কেন্দ্রে অবস্থিত ছিল। ব্যবসা তার স্বচ্ছলতার সূত্র। নদীমাতৃক দেশ হওয়ার সুবাদে নদীজাল নির্ভর করে আন্তঃদেশিয় এবং বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থানের আন্তর্জাতিক সমুদ্র নির্ভর ব্যবসা ও সওদাগরি বাণিজ্যের তথ্য পাচ্ছি দ্বিতীয় খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকেই। এই আলোচনা আমরা দুটি অংশে ভাগ করব।
প্রাচীন পর্ব- প্রাচীন বাংলা বলতে অতীত বাংলার প্রাচীন চারটি বিভাগ পুণ্ড্রবর্ধন, রাঢ, বঙ্গ এবং সমতট-হরিকেল এবং আজকের সীমান্তের দুপাশের বাংলা কথা বলব যার সঙ্গে জুড়ে ছিল বিহার, ওডিসা। বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান দেশিয় এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পক্ষে অনুকূল ছিল। উপকূল অঞ্চলে গঙ্গার বদ্বীপ, এবং উত্তরসীমান্তে হিমালয় নিয়ে যে বাংলা সেটি আসলে একমাত্র ভারতীয় অঞ্চল, যাকে আসমুদ্রহিমাচলরূপে বর্ণনা করা যায়। মধ্য গঙ্গার সমতলভুমি এবং বিস্তৃত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা বাংলা জুড়ে নদীজালে আন্তঃবাণিজ্য চলত, আর বিশ্বের সব থেকে সব থেকে বড় বদ্বীপ, গঙ্গার বদ্বীপ অঞ্চল দিয়ে ভূমি ঘেরা গাঙ্গেয় অঞ্চলের বাণিজ্য পণ্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দ্বারে পৌঁছে যেত।
আগে যে চারটি অঞ্চলের কথা উল্লেখ করা গিয়েছে, সেগুলি কোন এক রাজতন্ত্রের অধীনে একত্রীভূত না হওয়ায় রাজনৈতিকভাবে এই অঞ্চলে অসমান রাজনৈতিক বৈষম্য দ্যাখা দিয়েছে। এই অঞ্চলের সামাজিক, আর্থিক এবং কৃষ্টিগত ইতিহাসের মধ্যে যেমন কোন সমতা নেই, তেমনি সেগুলির বিকাশ সরলরৈখিকও নয়। অন্য ভাষায় বাংলার বাণিজ্য উদ্যমে এই অঞ্চলগুলির সমাজ, রাজনৈতিক এবং কৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য প্রভূত প্রভাব ফেলেছে।
বাংলার প্রাচীন যুগের বাণিজ্যকে এই উপমহাদেশের বাণিজ্যের প্রেক্ষিতেই বিচার করতে হবে। বাংলার মূল স্বচ্ছলতা ছিল কৃষি উৎপাদন ভিত্তিক। অর্থশাস্ত্রে বর্ত্তর(বৃত্তি বিষয়ক জ্ঞানচর্চা) মধ্যে কৃষি আর বাণিজ্য ছিল। পালিতে লিখিত মজঝ নিকায়তে বলা হয়েছে কৃষ্টি তুলনায় বাণিজ্যে লাভ বেশি। অঙ্গুত্তর নিকায়ে স্পষ্ট বলা হয়েছে ব্যবসায় বিপুল লাভের কথা। পঞ্চম শতাব্দের বৈয়াকরণিক পাণিনীর লেখায় ব্যবহার বা ব্যবসা সূত্রে ক্রয়-বিক্রয়ের শব্দ দুটির উল্লেখ পাই। অতীত বাংলার ব্যবসার উল্লেখ পেতে আমাদের নির্ভর করতে হয় দেশিয় সাহিত্যের ওপর( normative এবং creative) এবং বৈদেশিক ভ্রমনকারীদের লেখনি(ধ্রুপদী, চিনা, আরবি, পারসিক, ইওরোপিয়), শিলালেখ, মুদ্রা এবং বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন এলাকা থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদির ওপর। বিভিন্ন উৎসের সূত্র থেকে ষষ্ঠ খ্রিষ্টপূর্ব সময় থেকে বাংলার ব্যবসা বাণিজ্যমর্ম জানতে সাহায্য করে। আমরাও সেই সময় থেকেই আলোচনা শুরু করব। এই তথ্যগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এবং ব্যপ্ত, কিন্তু বিপুল আলোচনার জন্য যথেষ্ট নয়, এবং কোন সংখ্যাতাত্ত্বিক তথ্য পাওয়া যায় না বলেই আমাদের গুণগত উপাত্তের ওপর নির্ভর করতে হয়।
আবারও বলি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের যে রাজনৈতিক, সামাজিক অবস্থা তার সঙ্গে সর্ভভারতীয় এমনকি উত্তরভারতীয় বাস্তবতার কোন মিল ছিল না। উত্তর এবং উত্তর পশ্চিম এলাকায় যখন ২৫০০ থেকে ১৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে শহরীকরণের প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি, বাংলায় কিন্তু তার প্রভাব খুব সামান্যই। ষষ্ঠ খ্রিপূর আশেপাশের সময় থেকে গাঙ্গেয় উপত্যকায় যখন বেশ কিছু পরিমানে শহর তৈরির কাজ হয়ে মহাজনিপদের বিকাশ ঘটছে, তখন বাংলা নিরুত্তাপ। মনে রাখা দরকার, sedentary agriculture (কৃষিবাণিজ্য?), বৈচিত্রময় কারিগরি ও বাণিজ্য কিন্তু চতুর্থ খ্রিপূর্বাব্দে মৌর্য সাম্রাজ্যের আগে উদ্ভব হয় নি। মনে হয় গাঙ্গেয় উপত্যকায় মগধ সাম্রাজ্যের বিকাশে material culture এর বিকাশ ঘটছিল, তার প্রভাবে বাংলায় কৃষি, বৈচিত্র্যময় কারিগরি ও বাণিজ্যের বিকাশ ঘটে বিভিন্ন শহর কেন্দ্রে।

পণ্যাদি – কৃষিকর্ম দিয়েই এই আলোচনা শুরু করি। তৃতীয় খ্রিপূর প্যালিওজিওগ্রাফির হিসেবে আর মহাস্থানের শিলালেখ সূত্র পুণ্ড্রবর্ধনের ধান আর তিলের বর্ণনা পাচ্ছি। এটা উল্লেখ যে এই দুধরণের শস্য পুণ্ড্রনগর বা আজকের বোগরার মহাস্থানের শস্যাধার(কোষ্ঠাগার)এ রাখা হত। এটি বাংলার অন্যতম প্রাচীন শহর এবং শষ্যগুলি শহরের অধিবাসীদের ত্রাণ(আত্যয়িক) বিতরণের জন্য রাখা ছিল। আদতে যে কোন ধরণের ত্রাণের জন্য এই পণ্যগুলি জমিয়ে রাখা হত। অর্থশাস্ত্রে এই ধরণের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর গোলা তৈরি করার জন্য পণ্যাধ্যক্ষ পদের উল্লেখ রয়েছে; তাদের দায়ত্ব ছিল বিভিন্ন আপৎকালে এই শস্যগুলির বিতরণ। এই সূত্রে বলতে পারি উত্তরবঙ্গে বিভিন্ন শস্যের হয় বেশ কিছু উদ্বৃত্ত তৈরি হত, যার একটা অংশ এই ধরণের গোলায় মজুদ রাখা হত। আন্দজ করা যেতে পারে শস্য ব্যবসায় সরকারকে নিযুক্ত থাকতে হত। কিন্তু অন্য কোন সূত্রে সরকারের পক্ষে সরাসরিভাবে শস্য ব্যবসায় অংশগ্রহনের কোনো রকম উল্লেখ পাচ্ছি না।