রণবীর চক্রবর্তী
সাম্প্রতিককালের
দক্ষিণ ২৪ পরগণা এবং মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকেতুগড় এবং তাম্রলিপ্তির প্রত্নতাত্ত্বিক
উতখননে এ বাদদে অনেক তথ্য পাচ্ছি। এই অঞ্চলে প্রাপ্ত পোড়ামাটির শিলালিপি এবং সিলগুলিতে
খরোষ্ঠি এবং খরোষ্ঠী-ব্রাহ্মির মিশ্র লিপির যে কার্বন-তারিখ পাওয়া গিয়েছে, তার সময়
নির্ণিত হয়েছে প্রথম খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে চতুর্থ শতক পর্যন্ত। বিভিন্ন সিলে
পাওয়া গিয়েছে মাস্তুল তোলা জাহাজ, ধান্যশীর্ষে আর ফসল শীর্ষনালিকার নানান ছাপ,
বিভিন্ন শস্য ছাপওয়ালা শস্য বহনের পাত্রের(শস্যাধার)ও ছাপ পাওয়া গিয়েছে।
ব্যবসায়ীরা খাদ্য(হয়ত ধান/চাল) ব্যবসা করে ধনী হয়েছেন তার উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। এই
সময়ের বাংলা যে বিপুল শস্য উৎপাদন আর আন্তঃরাজ্য এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে রপ্তানি
করত, এগুলি তার প্রত্যক্ষ উদাহরণ। অনেক পরে চতুর্দশ শতকের ইবন বতুতা এবং পঞ্চদশ
শতকে মাহুয়ানের লেখাতেও বাংলার ধান মালদ্বীপে রপ্তানির বিনিময়ে কড়ি ব্যবসার উল্লেখ
পাচ্ছি।
এই গুরুত্বপূর্ণ
শস্যের পাশাপাশি উত্তরবঙ্গ, পুণ্ড্রবর্ধনে আখ(ইক্ষু) চাষের উদাহরণ পাচ্ছি, সেই
আখের প্রজাতির নাম কিন্তু এলাকার নামে - পুণ্ডু আখ। এটাও আমরা প্রাসঙ্গিকভাবে ভেবে
নিতে পারি, চালের মতই বাংলার আখের পণ্যের বিপুল চাহিদা বাংলার বাইরে এবং
আন্তর্জাতিক স্তরে ছিল, যেটা আদতে বাংলার লালা ও সাদা চিনি(এবং গুড় – এটা লেখক
বলেন নি – গৌড়=গুড় এটাও মনে রাখা দরকার)।
দক্ষিণের গাঙ্গে বা গঙ্গে
দেশ বা গাঙ্গেয় বদ্বীপের নিম্নাংশের উল্লেখ পাচ্ছি প্রথম শতাব্দের দ্বিতীয় অংশে
লিখিত পেরিপ্লাস অব ইরাথ্রিয়ান সি নামক গ্রন্থে। এই বইতে আমরা বাংলার বৈদেশিক
বাণিজ্য শৃঙ্খলে বেশ কিছু পণ্যের অমেয় উল্লেখ পাচ্ছি যেমন মালাবাথরুম(সং>
তামলপত্র, বাং>তেজপাতা), নার্দ(সং>নালদ, নারদ হয়ত Nardostachys grandiflora) এক ধরণের বিশেষ গন্ধ তেল। পেরিপ্লাস বলছে এই ধনীভোগ্য
পণ্যগুলির বিপুল চাহিদা ছিল রোমের অভিজাতদের জীবনধারণে। একই ধরণের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে
দ্বিতীয় শতকে লিখিত একটি ঋণ-চুক্তি বিষয়ের ভুর্জপত্রে। এই সূত্র আমাদের জানাচ্ছে
গাঙ্গেয় নার্দ বিপুল পরিমানে মালাবার উপকূলের মাজুরিস বন্দরে(আজকের কেরলের
ক্রাঙ্গানোরের কাছে) হার্মোপোলন নামক জাহাজে ভর্তি করে সেটি আলেকজান্দ্রিয়ায় রওনা
হয়ে যাবে। যদিও পেরিপ্লাস বলছে তেজপাতা আর নার্দ বাংলার পণ্য, আদতে এগুলি মূলত উত্তরপূর্বের
রাজ্যগুলো থেকে চাষ এবং প্রক্রিয়া জত হয়ে বাংলার উপকূলে রপ্তানির জন্য আসত। এই
ধনীভোগ্য পণ্য উপকূল সমুদ্রপথ দিয়ে রপ্তানির জন্য মালাবারে পাঠানো হত। সেখান থেকে
চলে যেত ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায়। ফলে আমরা বলতে পারি যে সব ট্রানজিট দ্রব্য বাংলার
মধ্যে দিয়ে পুণঃরপ্তানি হত সেগুলির মধ্যে এই দুটি অন্যতম।
ঠিক একই গঙ্গে
অঞ্চলের উৎপন্ন দামি ও সূক্ষ্ম মসলিনের উল্লেখ আমরা পেরিপ্লাসে বিপুলভাবে পাচ্ছি।
এই পণ্যটি বাংলার উপকূল দিয়ে বিপুল সংখ্যায় বিদেশে যেত। এছাড়াও চিনা রেশমের লাছা,
সুতো এবং চিনাংশুক গঙ্গে এলাকা হয়ে দ্রাবিড় অঞ্চলে যেত। চৈনিক রেশম স্থানীয় উৎপাদন
মসলিনের মতই অত্যন্ত দামি পণ্য এবং ধনীভোগ্য এবং এটাও বাংলার অন্যতম ট্রানজিট পণ্য
হিসেবে গণ্য হত। কিন্তু বাংলার তাঁতের সুখ্যাতি আমরা পাচ্ছি তৃতীয় খ্রিষ্টপূর্বে
লিখত অর্থশাস্ত্রে। (তার আগে সে রকম উল্লেখ পাচ্ছি না) কিন্তু তারপর থেকে বিভিন্ন সূত্রে
আমরা দেখছি বাংলার তাঁতিদের সুখ্যাতির নানান বর্ণনা নবম থেকে চতুর্দশ শতকে লিখিত
আরবি আর পার্সি, চিনা লেখক, মার্কোপোলোর(ত্রয়োদশ শতে) মত লেখকদের নানান উল্লেখে। সক্কলে
যদিও বাংলায় আসেন নি, কিন্তু বাংলার তাঁতের সুখ্যাতি তারা তাঁতের উৎপাদন, তার
ব্যবসার সঙ্গে জুড়ে থাকা মানুষজনের থেকে সংগ্রহ করেছেন। ১২২৫ সালে চিনা আধিকারিক,
চাউ জু কুয়া, পোং-কিয়েলো আর্থাত বাংলার(ভাঙ্গালা) সুতির(তৌলো) সূক্ষ্মবস্ত্রের
সুখ্যাত করেছেন।
অষ্টম শতকের পর থেকে
বাংলায় সুপারি(গুবাক) এবং পানের(বরজিক শব্দ পাচ্ছি পানের উৎপাদক, বিক্রেতা সূত্রে)
উল্লেখ পাচ্ছি। এই সময়েই বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় পাওয়া শিলা/তাম্রলেখতে নারকেল
গাছের উল্লেখ পাচ্ছি – এটারও হয়ত ব্যবসা হত। নবম এবং ত্রয়োদশ শতের তাম্রশাসনে
খাদ্যে গুরুত্বপূর্ণতম উপাদান নুনের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে, বিশেষ করে উপকূলীয়
এলাকায়।
নবম থেকে ত্রয়োদশ শতকের
আরব সূত্র থেকে জানতে পারি বাংলা। বিশ্ববাণিজ্যে অসাধারন কাঠের সূত্র ছিল। আরব
লেখকদের লেখায় উল্লিখিত সমন্দর বা সুদকাওয়ান(আজকের চট্টগ্রামের কাছাকাছি) অঞ্চলে
কামারুণি নামক কাঠের উল্লেখ করেছেন, যা মুলতানি কাঠের পরেই বাণিজ্য ক্ষেত্রে গণ্য
এবং দামি হয়। এটি কামারুণ বা কামারুন এলাকার বনজ উৎপাদন। এই কাঠ অসমের জঙ্গল থেকে
মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে আনা হত। আরবি আর পারসি সূত্রে গণ্ডারের শিং উক্ত বন্দর থেকে
রপ্তানির উল্লেখ পাচ্ছি। এটি আরেকটি বিলাস দ্রব্য। এবং সেটি অসম সূত্রেই
চট্টগ্রামের বন্দরে আসত।
No comments:
Post a Comment