রণবীর চক্রবর্তী
বাজার আর ব্যবসায়ী -
আমাদের হাতে যে সব তথ্য আছে তাতে পরিষ্কার যে এ জন্য বাংলায় নির্দিষ্ট বাজারে এসে ব্যবসায়িরা
পণ্য হাত বদল করতেন। বাংলা জুড়ে নানান ধরণের বিশেষ বিশেষ বাজার ছিল এবং এই বাজারে
বিশেষ ধরণের ব্যাপারীরাও ছিল।
বাংলার অন্যতম
গুরুত্বপূর্ন ব্যবসায়িক কেন্দ্রগুলি ছিল পুণ্ড্রনগর, কোটিবর্ষ, মঙ্গলকোট,
কর্ণসুবর্ণ, রামাবতী, বিক্রমপুরা। এগুলি সে সময়ের রাজনৈতিক প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল,
একই সঙ্গে ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবেও কাজ করত। অতীত বাংলায় এই এলাকাগুলি সব থেকে
গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসাকেন্দ্রগুলির মধ্যে প্রথমসারির ছিল। এই শহরগুলোর সঙ্গে বন্দর,
সে সময়ের নাম ছিল পত্তন বা ভেলাকুলের যোগ থাকত। প্রথম সহস্রাব্দের আগের শতক থেকে
অষ্টম শতক পর্যন্ত তাম্রলিপ্তি ছিল পূর্বাঞ্চলের জমিবদ্ধ গঙ্গা উপত্যকার সব থেকে
বড় বন্দর। রূপনারায়ণের ওপরের এবং ধারণা করা হয় বর্তমান তমলুক শহরে এই বন্দরের
অবস্থান। তাম্রলিপ্তর পুরনো নাম ভেলাকুল। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে কিন্তু সাহত্যিক
দাবির প্রমান মেলে নি, যা আমরা বিভিন্ন লেখমালা বা সাহিত্যিক সূত্রে জানছি। টলেমি
একে তামোলিতি নাম দিয়েছেন আর প্লিনি বলেছেন তালুক্তে। হিউএনসাঙ্গের বর্ণনায়
তান-মো-লি-তি সে সময়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থলে ছিল, বিশেষ করে
বঙ্গোপ্সাগরের সামুদ্রিক বাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হিউএনসাঙ্গ(৬৩৯-৪৫ খ্রি)
ছাড়াও তাঁর আগে ফা হিয়েন (৩৯৯-৪১৪ ক্রি) এই বন্দর দিয়েই গতায়াত করেছেন।
পেরিপ্লাস এবং
টলেমির ভুগোলে(১৫০ খ্রি) গঙ্গে নামক একটি বন্দরের অবস্থান দেখানো হচ্ছে যেটি গঙ্গা
আর সমুদ্রের মোহানায় অবস্থিত। আজও পর্যন্ত এই বন্দরটি যে চন্দ্রকেতুগড়ের বন্দর এমন
কোন লিখিত প্রামান্য তথ্য পাওয়া যায় নি। বিদ্যাধরী নদীর তীরে অবস্থিত চন্দ্রকেতুগড়
প্রথম সহস্রাব্দের প্রথম তিন শতক তার পূর্ণ উজ্জ্বলতায় টিকে ছিল। সেখানের উৎখনন
থেকে আবিষ্কৃত ত্রাপক্য ধরণের উপকূল ধরে ধরে চলার জাহাজ এবং সমুদ্রগামী জাহাজ,
জলাধিশক্র(সমুদ্রের ইন্দ্র) বিদেশ যাত্রার(ত্রিদেশযাত্রা) অনুকূল ছিল বলে মত
প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাম্রলিপ্তি প্রাচীন বাংলার সব থেকে গুরুত্বতম এবং
উজ্জ্বলতম বন্দর, চন্দ্রকেতুগড়/গঙ্গে তার থেকে বেশ ছোট ছিল এবং তাম্রলিপ্তিকে তার
পশ্চাদভূমির পণ্যসামগ্রী পাঠানোর কাজে ব্যবহৃত হত।
তবে সাহিত্যক সূত্রে
তাম্রলিপ্তির অবস্থান আমরা অষ্টম শতের পরে আর পাচ্ছি না। রূপনারায়ণে পলি জমতে
থাকায় বন্দরটি আস্তে আস্তে তার বৈদেশিক বন্দরের চরিত্র হারাতে হারাতে মৃত হতে
থাকে। বিপুল বিশাল বন্দরের মৃত্যু পূর্ব ভারতের অর্থনীতির ওপর তীব্র আঘাত আসে।
কিন্তু আজকের বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্ব অঞ্চলের সমতট-হরিকেল অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বৈদেশিক বাণিজ্যকে ধরে রাখে, যার বিবরণ আমরা পাই সপ্তম শতে ফা
হিয়েনের লেখা থেকে।
এছাড়াও আরব(অনেকের
মধ্যে সুলেইমান, ইবন খোরদাদবেদ, অল মাসুদি, অল ইদ্রিস, অল মারভাজি এবং ইবন বতুতা
মুখ্যত), পারসিক(আদুদ অল আলম) এবং চৈনিক (চাউজুকুয়া এবং চেং হোর অভিযান) বর্ণনায়
সমন্দর, সুদকাওয়ান, বা সাত্তিগাঁও আজকের চট্টগ্রামবন্দরের কাছাকাছি কোথাও অবস্থিত
ছিল। তাম্রলিপ্তির ধ্বংস কিছুটা পুষিয়ে দিয়েছিল এই বন্দরের উল্কাসম উত্থান। এবং ষষ্ঠ
শতে পর্তুগিজেরা এই বন্দরের নাম দেয় পোর্ট গ্রাণ্ডে।
তাম্রলিপ্তর মতই
সমুন্দরের অনেকগুলি নদী পরিবহন ভিত্তিক পণ্য সরবরাহ বন্দর ছি্ল। এগুলির মধ্যে দুটি
প্রধানতম দেবপর্বত এবং বঙ্গসাগরসম্বন্ধ্রিয়ক(Vangasagarasambhandariyaka)। দেবপর্বত ময়নামতিতে অবস্থিত ছিল, সপ্তম থেকে দশম শতের
কিছু শিলালিপিতে বলা হয়েছে সে সময় এই শহর ঘিরে ছিল ক্ষিরোদা নদী। সেই নদীতে নৌকো
আর সর্বতোভদ্র(সব দিক দিয়ে নৌকোয় প্রবেশ করা যায় একন একটি জলযান?) ভিড় করে থাকত। নদী
বন্দর ছাড়াও এটি সে সময়ের জয়স্কন্ধাবারও ছিল – আদতে সমতটের দেব শাসকদের রাজনৈতিক-প্রশাসনিক
ক্ষমতার কেন্দ্রও ছিল। এর নাম বঙ্গসাগরসম্বন্ধ্রিয়ক। ৯৭১ সালের চন্দ্র বংশের শিলালেখ
সূত্রে সাভারে এই নদী বন্দরের অবস্থিতির উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। এই বন্দরটির নামটির
কারণ এই বন্দরে সম্বন্ধর বা গুদামের ব্যবস্থা ছিল, এবং বঙ্গোপসাগরে(বঙ্গসাগর) এটির
যোগসূত্র ছিল। অনেকের ধারনা সাভার নামটি সম্বন্ধর শব্দজাত।
No comments:
Post a Comment