Wednesday, December 13, 2017

উপনিবেশপুর্ব বাংলা বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য১১

সুশীল চৌধুরী

মধ্যযুগ
১৬৭০এর কাছাকাছি সময়ে ইওরোপে বাংলার রেশমের ব্যবসা শুরু হওয়ায় বাংলা বাণিজ্যে বিপুল পরিমানে হতে থাকে। কিন্তু ১৬৮০সালে বাংলার কাপড় ইওরোপের বস্ত্র পরিধানের ব্যবস্থার আমূল বদল আনে। বাংলার সঙ্গে ইওরোপের বিশাল বিপুল ব্যবসা শুরু হয় যা এশিয় ব্যবসাকে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করে। এতদিন গ্রীষ্মে পশ্চিম ইওরোপের ধনী আর অভিজাতরা হয় মোটা ইওরপিয় রেশম আর মূলত পশমের কাপড় পরতেন। বাংলার তাঁতিরা তাদের দেখাল কি করে সুতি আর সূক্ষ্ম বাংলার রেশম ব্যক্তির দেহে স্বাচ্ছন্দ্য আনতে পারে ইওরোপের প্যাচপ্যাচে গ্রীষ্মে। এরপর থেকে মধ্য অষ্টাদশ শতকের পলাশী চক্রান্ত পর্যন্ত বাংলা হয়ে উঠল এশিয়া সব থেকে বড় উত্তমর্ণ। ডাচ আর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার সঙ্গে ইওরোপ আর এশিয়ার সামুদ্রিক ব্যবসার অন্যতম গুরুত্বপূর্ন বাহন হয়ে উঠতে শুরু করে। পলাশী চক্রান্তের পরে ব্রিটিশ কোমপানির আমলারাই বাংলার মহামহিম শাসনকর্তা এবং তার পর থেকে বাংলার ব্যবসার ইতিহাস হেঁটমুণ্ডঊর্ধ্বপদ হয়ে পড়ে।
এশিয় ব্যবসায় বাংলার গুরুত্ব একটা তথ্য থেকেই প্রমান করা যায়, অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে ডাচ ভিওসি নেদারল্যান্ডে যত পরিমান উপমহাদেশিয় পণ্য পাঠাত তার ৪০ শতাংশ কিনত বাংলা থেকেই। মোট এশিয় ব্যবসার বস্ত্রপণ্যগুলির মধ্যে ৫০শতাংশ ছিল বাংলার। ভারত উপমহাদেশে ডাচেদের সামগ্রিক সামুদ্রিক ব্যবসা ক্ষেত্রে বাংলা প্রধান কর্মক্ষেত্র হয়ে ওঠে। ব্রিটিশদের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। ব্রিটিশ কুঠিয়ালেরা বাংলাকে কোম্পানির বাগানের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুল আর মুকুটের সর্বশ্রেষ্ঠ রত্ন হিসেবে গণ্য করত। ১৬৫০ থেকে ১৭২০ পর্যন্ত বাংলা ব্যবসা ক্ষেত্রে ডাচেরা ব্রিটিশদের তুলনায় প্রায় সব ক্ষেত্রেই এগিয়েছিল। আস্তে আস্তে ব্রিটিশেরা ডাচেদের সমকক্ষ হয়ে উঠতে শুরু করে, কিন্তু তাও বহুকাল পর্যন্ত ডাচেদের এশিয় ব্যবসার প্রাধান্যে তারা দাঁত ফোটাতে পারে নি। ১৭৩০এর দশক থেকে ব্রিটিশদের ইওরোপিয় ব্যবসার পরিমান বাড়তে থাকে এবং সেটি বিপুলাকারে পৌঁছায় ১৭৪০-৪৫ সাল নাগাদ। তবে সেই চল্লিশের দশকে কিছুটা কমে, আবার পঞ্চাশের দশকে বাড়তে থাকে। কিন্তু যে পরিমান ব্যবসা কমে, সেই পরিমানটি ১৭৩০-৫৫ সময়ে গড় বাংলা থেকে রপ্তানি হওয়া মোট বাৎসরিক মূল্যে কিন্তু খুব বেশি কিছু ছিল না – গড় ছিল ৪৪০০০০ স্টার্লিং পাউন্ড কমে হয় ৩.৫ লক্ষ স্টার্লিং পাউন্ড। তবে পঞ্চাশের দশকে ব্রিটিশ বাণিজ্যে যে ঘাটতি দ্যাখা যায় তা বাংলার ক্ষেত্রে পুষিয়ে যায় ডাচেদের বাণিজ্যের পরিমান বেড়ে যাওয়াতে এবং সামগ্রিকভাবে বাংলার সঙ্গে ইওরোপের মোট বাণিজ্যের অঙ্কে। ১৭৫০-৫৫ সময়ে বাংলার রপ্তানি বাণিজ্যে কোন নিম্নাভিমুখ দ্যাখা যায় নি।
১৭২০ সালের পরে ডাচেদের ইওরোপিয় ব্যবসা মার খেতে শুরু করলেও সেটি ১৭৩০ সাল নাগাদ আবার বাড়তে থাকে। তারপর থেকে ১৭৫৫ সাল পর্যন্ত বাংলা থেকে ইওরোপে পাঠানো গড় ডাচ রপ্তানির পরিমান ক্রমাগত বেড়েছে। সেই শতকের পঞ্চাশের দশকে ব্রিটিশদের ইওরোপিয় বাণিজ্য কিছুটা কমতে থাকে। উল্লেখ্য ১৭৩০ সালে ডাচেরা মোট ব্যবসায় ব্রিটিশদের পিছনে থাকলেও ক্রমশ তাদের সমান সমান হতে থাকে। ১৭৩০এর পরে কিন্তু ডাচেদের ইওরোপে রপ্তানি নিয়মিতভাবে কমতে শুরু করে। ১৭৫০এর পর প্রথম পাঁচ বছরে ইওরোপে ডাচেদের গড় রপ্তানি ছিল ২.৩ মিলিয়ন সেখানে এশিয় বাজারে তারা ব্যবসা করেছে ৩ মিলিয়ন।

এ প্রসঙ্গে বলা দরকার ইওরোপিয়দের এশিয় ব্যবসার তুলনায় মধ্য অষ্টাদশ শতকে এশিয়দের এশিয় ব্যবসার পরিমাণ অনেক বেশি ছিল। এশিয় সওদাগরেরা বাংলার কাপড় ব্যবসা করেছে বছরে গড়ে ৮ থেকে ১০ মিলিয়ন। সেই তুলনায় বাংলা বস্ত্রের ইওরোপিয়দের মোট ইওরোপিয় ব্যবসার পরিমান ছিল খুব বেশি হলে ৫ থেকে ৬ মিলিয়ন। রেশম রপ্তানিতে এশিয়দের ব্যবসা আরও গুরুত্বপূর্ন। ১৭৪৯ থেকে ১৭৫৩ পর্যন্ত এশিয় সওদাগরদের এশিয়ায় কাঁচা রেশম রপ্তানির পরিমান ছিল ৫.৫ মিলিয়ন, ১৭৫৪ থেকে ১৭৫৮ পর্যন্ত ৪.১ মিলিয়ন গড়ে। এর তুলনায় এই সময়ে ইওরোপিয়দের মোট রেশম রপ্তানি ছিল গড়ে ০.৯৮ মিলিয়ন। পলাশীপূর্ব সময়ে বাংলা থেকে এশিয় ব্যবসায়ীদের রেশম ব্যবসার পরিমান ইওরোপিয়দের তুলনায় ৪ থেকে ৫গুণ বেশি ছিল। 

No comments: