রণবীর চক্রবর্তী
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ
প্রাণীর ব্যবসা সাম্প্রতিক দশকগুলির গবেষণায় উঠে এসেছে, সেটি ছিল যুদ্ধ ঘোড়া।
বাংলা কেন ভারতের কোন অঞ্চলেই ভাল যুদ্ধ ঘোড়া তৈরি হত না – সেগুলি আসত মূলত
মধ্যএশিয়ার দেশ সমূহ থেকে। তারা প্রথমে আসত উত্তরপশ্চিম সীমান্ত হয়ে উত্তর ভারতে।
তৃতীয় শতের কাং তাইএর লেখা সূত্রধরে জানছি য়ুয়ে-চি(কুষাণ) ব্যবসায়ীরা কোয়িং দেশে
ঘোড়া নিয়ে যেত। কোয়িং দেশ মালয় উপদ্বীপ অঞ্চলে অবস্থিত। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার
সাঞ্জেন দ্বীপে পাওয়া যাওয়া একটি তাম্র পত্রে একজন য়ুয়ে-চি ব্যবসায়ীর একটি চিত্র
অঙ্কন করা আছে যিনি একটি ঘোড়ার পাশে দাঁড়িয়ে। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলা দরকার উত্তর
ভারতের সঙ্গে মালয় উপদ্বীপের যোগাযোগ বাংলার উপকূলীয় অঞ্চল মাধ্যমে হত। এর সঙ্গে
যুক্ত করতে হবে চন্দ্রকেতুগড়ে প্রাপ্ত তৃতীয় শতের একটি পোড়ামাটির সিলে মিশ্র
ব্রাহ্মী-খরোষ্ঠী লিপিতে লেখা একটি ঘোড়ার সঙ্গে একটি পাল বিশেষ্ট জাহাজের ছাপা ছবি।
এর সঙ্গে লেখাটির পাঠোদ্ধার করে বোঝা গিয়েছে জাহাজটির নাম ত্রাপ্যক, যে নামের
সঙ্গে মিল আছে পেরিপ্লাসে উল্লিখিত ত্রাপাগগা বা জৈন পুঁথি অঙ্গবিজ্জয় লিখত ত্র্যাপ্যগ্যর
সঙ্গে। এই সিলটি আদতে বাংলার উপকূল থেকে জাহাজে ঘোড়া নিয়ে যাওয়ার আপাতত আদিতম
নিদর্শন। তামিক সঙ্গম সাহিত্য থেকে জানতে পারি, উত্তরভারত থেকে তামিলনাড়ুর উপকূলে
ঘোড়া পৌঁছত। এর থেকে বাংলা যোগ স্বাভাবিকভাবেইও প্রমান হয়।
এই উদাহরণ থেকে আমরা
বুঝতে পারি যে তৃতীয় শতকের আগে থেকেই বাংলার উপকূলীয় বাণিজ্য মালয় উপদ্বীপ এবং
তামিলনাড়ুতে ঘোড়া ব্যবসায় যুক্ত ছিল। ক্রমশ বাংলায় যুদ্ধ ঘোড়া চাহিদা বাড়তে থাকে
পাল এবং সেন আমল(১৫০-১২০৫খ্রি) এই অঞ্চলের গুরুত্বপুর্ণ শক্তি হয়ে ওঠায়। এই সময়ে
ঘোড়া প্রসঙ্গ আমরা পাচ্ছি পাল রাজত্বকে বিপুল সঙ্খ্যক ঘোড়সওয়ার বাহিনী উপহার দিচ্ছেন
উত্তরভারতের করদ রাজারা। যদিও এটা বাঁধাগতের এবং প্রশংসাবাদপূর্ণ দাবি হয়ে যাবে,
তবুও এই কথাটা না বলে পারছি না, উদিচ্য বা উত্তরাপথ বাংলার রাজাদের মূল ঘোড়া
সরবরাহ অঞ্চল ছিল। ৮৪৮ সালের একটি শিলালেখতে আজকের হরিয়ানায় প্রথুদক(পেহোরা)এ ঘোড়া
মেলার(ঘোটকযাত্রা) উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে।
ত্রয়োদশ শতকে তবাকতিনাসিরিতে
মিনহাজুদ্দিন সমস্ত ঘোমটা সরিয়ে বলছেন তৎকালীন নুদ্দায়(আজকের নবদ্বীপে) সেন আমলে
আরব অঞ্চল থেকে ঘোড়া আসত। এবং বাংলায় আরবিঘোড়ার ব্যবসায়ীদের গতায়াত এতই ঘনঘন এবং
সাধারণ ব্যাপারছিল, যখন বখতিয়ার খলজির ঘোড়সওয়ারেরা নদিয়ায় পৌঁছলেন, তখন জনসাধারণ
তাদের ঘোড়া ব্যবসায়ীই ভেবেছিলেন প্রথমে। রাঢ অঞ্চলের এই ঘোড়া ব্যবসা ছাড়াও লক্ষ্মণ
সেনের রাজধানী লক্ষ্মণাবতী বা লক্ষ্মৌতিতেও বিপুল পরিমান ঘোরা আসত দক্ষিণ তিব্বতের
উত্তরাংশ, পশ্চিম ভূটানের কারামবাটান বা কারামপত্তন বা কেরা গোম্পা থেকে। ফলে
বাংলাতে ঘোড়া আসত উত্তরপূর্ব আর উত্তরপশ্চিম উভয় দিক থেকে। পঞ্চদশ শতকের চিনা
পঞ্জিকা সূত্র পাওয়া যাচ্ছে মিং শাসনকালে বাংলার উপকূল থেকে চিন সাম্রাজ্যে ঘোড়া
সরবরাহ হত। বাংলার দুই পাশের দুই অঞ্চল থেকে নিয়ে আসা ঘোড়া চিনের দিকে নিয়ে যাওয়া
হত।
আরেকটি বিপুল
পরিমানে আমদানি করা পণ্য ছিল কড়ি – বিশেষ করে ৭৫০-১৩০০ সাল সময়ে। বাংলায় খুচরোর
বাজারে বিনিময় হিসেবে কাজ করত। কড়ির উৎপাদনের সঙ্গে বাংলার বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক
নেই। ইবন বতুতা আর মাহুয়ানের সূত্রে জানতে পারছি সেগুলি দূর সমুদ্রাঞ্চল – ভারত মহাসাগর
থেকে আমদানি করা হত। কড়ি আনা হত জাহাজের ওজন বাড়াবার জন্যে, ঠিক যেভাবে আগামী দিনে
ইওরোপে বাংলার সোরা যাবে। কড়ি ছাড়াও বাংলায় আরাকান আর পেগু থেকে আসত দামি ধাতু
রূপো। সঙ্গে টিনও – যদিও এটা দামি ধাতু ছিল না কিন্তু সঙ্কর ধাতু তৈরিতে কার্যকর ও
অত্যাবশ্যক ছিল।
বাংলার বাণিজ্যে,
বাংলার নিজস্ব এবং বাংলার বাইরের অঞ্চলের নানান বৈচিত্রময় ধরণের পণ্যের উপস্থিতি,
সে সময়ের বাণিজ্য বিশ্বে বাংলার স্থানিক গুরুত্বের প্রমান। নুনের মত খুব তুচ্ছ
দৈনন্দিন পণ্য থেকে সাধারণ চাল থেকে বাণিজ্যিক শস্য থেকে সাধারণ তাঁতের কাপড় থেকে
দামি মসলিন থেকে শুরু করে বিশ্বজোড়া ধণিক আর ক্ষমতাবানদের জন্য তৈরি এক্কেবারে
দামিতম মহার্ঘ্য পণ্যের উপস্থিতি এক সময় বাংলাকে বাণিজ্য বিশ্বে একটি অনন্য
মর্যাদা দিয়েছিল।
No comments:
Post a Comment