সুশীল চৌধুরী
মধ্যযুগ
মুঘল আমলে বাণিজ্য শস্য বিশেষ করে সুতা আর রেশম বিপুলভাবে উৎপাদিত হত বাংলার
বদ্বীপঅঞ্চলে। সুতা উৎপাদনের মূল কেন্দ্র ছিল ঢাকা; সেখান থেকে শুরু করে উত্তরের
মালদা এবং কাশিমবাজার থেকে দক্ষিণের হুগলি এবং মেদিনীপুর পর্যন্ত। ১৯৫৮ সালে র্যালফ
ফিচ বলছেন বাংলার সব থেকে সূক্ষ্ম আর ভাল সুতির কাপড় উৎপাদন হত সোনারগাঁওতে এবং
তার তুলনা ভারতের কোন এলাকাতেই ছিল না। মুঘল রাজত্বে অঙ্গীভূত হওয়ার দরুণ বাংলার
তাঁতিরা সরাসরি মুঘল পাদশাহির পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। মুঘল রাজসভার জন্য বিভিন্ন
ধরণের বিভিন্ন মানের সুতি বস্ত্র তৈরি করার প্রায় একচেটিয়া বরাত পেত বাংলার
তাঁতিরা। এ ছাড়াও কাশিমবাজার আর তার আশেপাশে অঞ্চলে উৎপাদিত কাঁচা রেশমের বিপুল
চাহিদা ছিল বিশ্বজুড়ে।
বাংলার কৃষি এবং শিল্প উৎপাদনে বিপুল উৎসার শুধু মুঘল রাজত্বে প্রবেশ করার
জন্য হয়েছে এটা ভাবলে ভুল হবে, বলা দরকার সেই সঙ্গে জুড়ে ছিল স্থলপথ এবং সমুদ্র
বাণিজ্যের বিপুল বিকাশ, এবং যেহেতু বাংলা বিশ্ব বাণিজ্য শৃঙ্খলে যুক্ত হতে পেরেছিল।
সুলতানি আমলের প্রথম যুগে পর্তুগিজ বাণিজ্য শক্তি বাংলার বঙ্গোপসাগর এলাকায় প্রবেশ
করে মধ্য ১৫৩০এর দশকে চট্টগ্রাম আর সাতগাঁওতে বাণিজ্য কুঠি তৈরি করে। ষোড়শ শতকের
শেষ দুই দশকে মুঘলেরা বাংলার হৃদকেন্দ্রে ঢুকে পড়ে এবং পর্তুগিজেরা হুগলি বন্দরকে
তাদের ব্যবসা ঘাঁটি বানায়, চট্টগ্রামে তাদের বসতি বসায় এবং ঢাকার আশেপাশের অঞ্চলে
বসতি এবং সওদাগরি উপনিবেশ তৈরি করে। একটা ধারনা আছে যে বাংলার সমুদ্র নির্ভর
সওদাগরি বাণিজ্যে পর্তুগিজেরা পরম্পরার সওদাগরদের হাটিয়ে নিজেদের ক্ষমতা বিস্তৃত
করেছিল, কিন্তু এই ধারনাটি যেমন বিন্দুমাত্রও সত্য নয়, এটা সত্যি যে, ষোড়শ শতাব্দে
বাংলা জুড়ে ইওরোপিয় বণিকদের উপস্থিতি বাংলার পণ্য ও কৃষি উৎপাদনেরমাত্রা
বাড়িয়েছিল।
ষোড়শ শতকের মধ্যিখানে বাংলার বন্দরগুলির মধ্যে সাতগাঁও ছিল গুরুত্বপূর্নতম।
মুকুন্দরামের বয়ানে পাচ্ছি, সাতগাঁওতে বিদেশি বাণিজ্যের রমরমার কথা। তিনি বলছেন
সাতগাঁওতে এত পরিমান বিদেশি বণিকদের আনাগোণা যে, সেখানকার বণিকদের আর বাণিজ্য করতে
বিদেশে যেতে হয় না, তারা তাদের গদিতে বসেই বিপুলাকায় বাণিজ্য করতে পারে। বাংলার
প্রধানতম বন্দর হওয়ায় সাতগাঁওতে বিশ্বের এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা নানান
ধরণের বণিক উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। ১৫৩৭ পর্যন্ত এটি পর্তুগিজদের প্রধান বাণিজ্য
কেন্দ্র হয়ে ওঠে। তারা এটির নাম দিয়েছিল পোর্ত পিকেনো বা ছোট বন্দর। এমন কি ১৫৬৯
সালে সিজার ফ্রেডরিকি দেখছেন বিপুল বিশাল সুন্দরতম সাতগাঁও শহর-বন্দর( remarkable faire citie) থেকে প্রতি বছর তিরিশটা বাংলার নানান পণ্য
ভর্তি জাহাজ বিদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হত।
কিন্তু ঐতিহাসিক সাতগাঁওএর সমৃদ্ধির পতন ঘটতে থাকে ঐতিহাসিক সরস্বতী নদীর খাত
পলি পড়ে বুজে যেতে থাকায়। ফলে এখান থেকে নৌচলাচল নির্ভর ব্যবসা চালানো খুব মুশকিল
হয়ে ওঠে। তাই স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈদেশিক ব্যবসাদার পর্তুগিজেরাও হুগলী শহরে
বন্দর স্থাপন করে সরে যায়। মধ্য অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত হুগিলিই বাংলার প্রধানতম
বন্দর হিসেবে কাজ করতে থাকে। যদিও দেশিয় বাণিজ্যর বিপুল অংশ হুগলিতে স্থানান্তরিত
হয়ে গিয়েছিল, তবুও ১৬৩২ সাল পর্যন্ত সাতগাঁও সাম্রাজ্যের প্রধান বক্সীর দপ্তর
হিসেবে কাজ করতে থাকে। ঐ বছর দপ্তরটি হুগলিতে উঠে না আসা পর্যন্ত এটি সরকারিভাবে
বাংলার প্রধানতম ব্যবসাকেন্দ্র ছিল। তারপরে হুগলিই সরকারিভাবে বাংলায় বক্সীদের
নিয়ন্ত্রিত প্রধান্ততম বন্দর হিসেবে চিহ্নিত হল।
পর্তুগিজদের কল্যাণে হুগলির উত্থান দ্রুত ঘটতে থাকে। বাংলার বিভিন্ন প্রধান
ব্যান্ডেলের(পর্তুগিজ ভাষায় বাণিজ্য কুঠি) মধ্যে হুগলি শহর সব থেকে প্রধানতম দর্শনীয়,
জনবহুল এবং স্বচ্ছলতম বন্দরের হিসেবে উঠে আসে। ১৫৩৩ সালে ফাদার জন কাব্রাল লিখলেন
হুগলি এই বাংলার পণ্যের প্রদর্শনী স্থান হিসেবে গড়ে উঠেছে। এবং এই বন্দর থেকে
পর্তুগিজ ভারতের প্রধানতম জাহাজগুলি চিন মালাক্কা এবং ম্যানিলার দিকে মুহুর্মুহু
রওনা হয় এবং সারাইও হয়ে থাকে। স্থানীয় বাণিজ্যের সঙ্গে জুড়ে থাকা দেশিয় মানুষদের
কথা উল্লেখ করে বলছেন, হিন্দুস্তানি, মোগোল, ফারসি এবং আরমেনিয়রা এইখানে পণ্য
কিনতে আসে। ১৫৮০ সালে ভ্যান Linschoten এবং র্যালফ ফিচ
লিখছেন হুগলির সমৃদ্ধির বর্ণনা। ১৫৯৬-৯৭ আইনিআকবরি লেখা শেষ হয় এবং এটিতে উল্লিখিত
হচ্ছে সাতগাঁওয়ের তুলনায় হুগলির সমৃদ্ধির তথ্য। পর্তুগিজদের বাংলা ব্যবসার উন্নতি
যখন চরম শিখরে, সে সময়ে মনরিকের লেখায় আবশ্যিকভাবে হুগলির উপস্থিতি এবং সেটির
সঙ্গে সঙ্গে বাংলার সমৃদ্ধি আর পর্তুগিজ ব্যবসার বর্ননা। দক্ষিণ ভারত(অর্থাৎ
সুমাত্রা, বোর্নিও, মলুক্কাস ইত্যাদি) এলাকা থেকে বিপুল পরিমানে কাজ করা রেশম যেমন
ব্রোকেড, ব্রোকাটেল, কাপড়, মলমল, দামাস্ক, সাটিন, টাফেটা মসলিন ইত্যাদি আমদানি
করে। তারা বোর্নিওর দ্বীপগুলি থেকে লবঙ্গ, জায়ফল জয়িত্রী ইত্যাদি আমদানি করত
বান্দা থেকে আর অসম্ভব দামি কর্পুর আমদানি করত মোর্নিওর দ্বীপগুলি থেকে। মালদ্বীপ
থেকে তারা বাংলায় আনত কড়ি যা সে সময় বাংলায় খুচরো মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হত। বড়
ধরণের সমুদ্রিক ঝিনুক আর শাঁখ('chanquo') আনত তুতিকোরিন এবং তিনেভেল্লির উপকূল থেকে।
গোলমরিচ মালাবার, দারচিনি আনত শ্রীলঙ্কা থেকে। চিন থেকে আনত বিপুল পরিমান
চিনামাটির তৈজস, মুক্তো আর গয়না, বিছানার পাশে রাখা টেবইল, টেবিল, বাক্স, সিন্দুক,
লেখার টেবল ইত্যাদি। বাংলায় বিপুল চাহিদাওয়ালা সালোর(মালেশিয়া) এবং তিমোর রাজত্ব
থেকে আনত সাদা আর লাল চন্দনকাঠ।
No comments:
Post a Comment