রণবীর চক্রবর্তী
এর আগে যে আমরা বিভিন্ন বন্দর বিষয়ে আলোচনা করেছি, তার থেকে প্রমান হয় যে ভূমিপরিবেষ্টিত
গঙ্গেয় উপত্যকা এবং নদীমাতৃক বাংলার বৈদেশিক যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিল এই
বন্দরগুলির সেবা। ষোড়শ থেকে ত্রয়োদশ শতে প্রাপ্ত বিভিন্ন শিলালেখতে উল্লিখিত নৌখাত,
নৌযোগ, নৌদন্ডক, নৌবন্ধক, নৌস্থিরবেগ, নৌপৃথিবীর মত নৌযোগ শব্দগুলো থেকে একটাই
বিষয় প্রমান হয় গঙ্গা এবং গঙ্গার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন আন্তঃযোগাযোগ সমৃদ্ধ নদীপথে
নানান ধরণের নৌযোগাযোগের একটি বিপুল বিস্তৃত ব্যবস্থা ছিল। উপকূল এলাকার বিভিন্ন
প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে বাংলার বর্তুলাকার তৈজস পাওয়া যাওয়া থেকে প্রমান হয় যে
বাংলার সঙ্গে এই সব এলাকার যোগাযোগ ক্রমশ বাড়ছে। পূর্ব উপকূলের নানান উৎখনন এলাকা
যেমন আলাগানাকুলম, কাবেরীপট্টিনম, আরিকামেদু, ভাসাভাসামুদ্রম, কাঞ্চিপুরম(সব
তামিলনাড়ু), অমরাবতি, সালিহুন্দ্রম, কিলঙ্গপট্টনম(সব অন্ধ্রপ্রদেশ) শিশুপালগড়(ওডিসা)
এবং বাংলার তাম্রলিপ্তি আর চন্দ্রকেতুগড়ে দ্বিতীয় শতাব্দ থেকে ২০০ খ্রিষ্টাব্দে
পাওয়া যাওয়া বর্তুলাকার পাত্রের উপস্থিতি প্রমান করে এগুলির মধ্যে আন্তঃসংযোগ।
৪১৪ সালে ফাহিয়েন তাম্রলিপ্তি থেকে চিনের উদ্দেশ্যে রওনা হন। সেখানে তিনি
সওদাগরি জাহাজ চড়ে শ্রীলঙ্কা পৌঁছন, শ্রীলঙ্কা থেলে জাভা হয়ে চিনের পথে রওনা হন।
এই তথ্য থেকে প্রমান হয় যে বাংলা থেকে শ্রীলঙ্কা থেকে দক্ষিণপুর্ব এশিয়ার বাণিজ্য
যোগাযোগ ছিল। হিউএনসাং স্পষ্ট বলছেন যে সমতটের সঙ্গে পেগু, শ্রীক্ষেত্র, দারাবর্তী
এবং যমনদ্বীপের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। এই তথ্য প্রমান হয় ৬৭৫ সালে ইতসিঙ্গএর সমতটে
হাজির হওয়ায় ঘটনাটি। তিনি দক্ষিণপূর্ব এশিয়া থেকে সমুদ্র পথে বাংলায় পৌঁছান। মলয়
উপদ্বীপে প্রাপ্ত ষষ্ঠ শতকের একটি শিলালিপি থেকে পাচ্ছি কর্ণসুবর্ণের আশেপাশের
রক্তমৃত্তিকার অধিবাসী মহানাবিক বৌদ্ধগুপ্তের নাম। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া
জমিদানের একটি শিলালেখ থেকে জানতে পাচ্ছি বাংলার সঙ্গে সরাসরি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার
যোগাযোগের সূত্রটি যেখানে দেবপালকে যবদ্বীপের রাজা বলপুত্রদেব নালন্দা
বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কিছু জমি বরাদ্দ করার জন্য অনুরোধ করছেন। এই কৃষ্টিগত
যোগাযোগের মধ্যে দিয়েই কিন্তু বিস্তৃত ব্যবসায়িক যোগের ইঙ্গিত পাই।
নবম থেকে ত্রয়োদশ শতকের আরব সূত্র থেকে পাচ্ছি, সমন্দর
থেকে নিয়মিতভাবে সিলান্দীব(শ্রীলঙ্কা), কাঞ্জা(কাঞ্চীপুরম), উরানসিন(ওডিসা)এর
যোগাযোগ ছিল। দ্বাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের পরের সময় থেকে মালদ্বীপের সঙ্গে সমুদ্র
পথে যোগাযোগ স্থাপন হল। ইবন বতুতা এই রাস্তা ধরে বাংলায় এসেছিলেন। তিনি বাংলার
উপকূল থেকে জাভা যাওয়ার পথে সোনারগাঁও থেকে চিনা সওদাগরী জাহাজ(জাঙ্ক) ধরে জাভা
যান, সেখান থেকে চিনে পোঁছন। সেনাপতি চেং হোর অভিযান সম্বন্ধে মা হুয়ানের বর্ণনা
থেকে অসম্ভবভাবে পরিষ্কার হয়ে যায় যে ১৪০৪ থেকে ১৪৩৩ পর্যন্ত তিনি সাত্তিগাঁও(চট্টগ্রাম)তে
চারবার এসেছিলেন। বাংলার উপকূলঅঞ্চল বিশেষ করে সমতট-হরিকেল যে বিপুলভাবে সমুদ্র
বাণিজ্যে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মালাক্কার উপদ্বীপের নানান দেশের এবং বঙ্গোপসাগরীয়
এলাকার উপকূলভূমির সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং বাণিজ্যে বড় ভূমিকা নিয়েছিল এই তথ্যগুলি প্রমান।
No comments:
Post a Comment