মধ্য অষ্টাদশ
শতকে বাংলায় কোন অর্থনৈতিক দুর্যোগও ছিল না। এই তত্ত্বের প্রবক্তারা(যদিও
সাম্প্রতিক গবেষণায় সরাসরি কেউই ‘অর্থনৈতিক সঙ্কট’ শব্দবন্ধটা ব্যবহার করেন নি,
কিন্তু তাদের প্রত্যেকের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ইঙ্গিত সেই দিকেই ছিল) বলা চেষ্টা
করেছেন বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থার পতন ঘটেছিল, ব্যবসা বাণিজ্য ঢালের দিকে এগোচ্ছিল,
সওদাগরেরা অস্বচ্ছল হচ্ছিল, খোলা বাজারের পণ্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছিল, এবং ব্রিটিশ
কোম্পানির রপ্তানি কমছিল। আমার এই বইতে আমি প্রমান করে দিয়েছি যে এই ধারণাগুলি
ধারনাই, এগুলোর কোন বাস্তবতা নেই। বিশেষ করে ইওরোপিয়দের মোট বাংলা পণ্য রপ্তানির
ক্ষেত্রে কোন ঘাটতি দ্যাখা যায় নি। ১৭৪০এর শেষ থেকে ১৭৫০এর শুরু পর্যন্ত ব্রিটিশ
রপ্তানি কমেছে কিন্তু বাংলার অর্থনীতির ধীরগতির জন্য নয়। বরং ব্রিটিশ অর্থনীতির
গতিহীনতাকে পুষিয়ে দেওয়া গিয়েছে এশিয় বাজারে ডাচ(এবং ফরাসী) রপ্তানি বৃদ্ধিতে।
এপ্রসঙ্গে বলা দরকার বাংলা থেকে এশিয় বণিকদের রপ্তানি, বিশেষ করে রেশম আর সুতি
বস্ত্রে, মধ্য অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলার অর্থনীতি জড়দার করতে বিপুল ভূমিকা পালন
করে গিয়েছে।
এই সব উদাহরণে
আমরা বলতে পারি না যে পলাশীপূর্ব সময়ে বাংলার ব্যবসা বাণিজ্য এবং বাংলার বণিকেরা
সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছিল। এছাড়াও সম্প্রতিকালে বলা হচ্ছে দাদনি বণিকদের যায়গায়
ইওরোপিয় কোম্পানিগুলি গোমস্তা প্রথা শুরু করায় বাংলার মধ্যসত্ত্বভোগীরা দুর্দশায়
পড়ে, এ তত্ত্বও গ্রহণযোগ্য নয়। ডাচেরা ১৭৪৭-৪৯ এই তিন বছর গোমস্তা প্রথা শুরু করেও
১৭৫০এ দাদনি ব্যবস্থায় ফিরে যায়। ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের দাদনি প্রথা থেকে
গোমস্তা প্রথায় যাওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের ব্যবসার ঢালপথে দ্রুতগতিতে
নেমে যাওয়ার প্রবণতা রোখা এবং আমলাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা বাড়ানোর উদ্যম। আজ এই তথ্য
পরিষ্কার যে গোমস্তারা মূল গন্ডগোলের উৎস ছিল। তাদের সক্রিয় সহযোগিতায় ব্রিটিশ
ব্যবসায়ীরা বাংলার নানান অগম্য স্থানে প্রবেশ করতে উদ্যমী হয়।
আরও বলা হচ্ছে
যে মারাঠা আগ্রাসনে বাংলার অর্থনীতি বিপুল সঙ্কটের মধ্যে পড়ে কারণ সে সময় ইওরোপ
থেকে আসা দামি ধাতু কমে যায় কারণ এই আক্রমনে বাংলার পণ্যের মূল্য বেড়ে যায় এবং
ব্রিটিশদের কেনার ক্ষমতা কমে যায়। এই তত্ত্বকেও আমরা খারিজ করেছি বাংলার নানান
ধরণের বস্ত্র রপ্তানির তথ্য ধরে ধরে এবং সেগুলোর দামের সঙ্গে বাজারের অন্যান্য
পণ্যের দামের তুলনা করে – দেখিয়েছি বাজারে পণ্যগুলির হঠাৎ বিপুল দামবৃদ্ধি
তত্ত্বের কোন ভিত্তি নেই। বরং ১৭৩০ আর ১৭৪০এর দশকের তুলনায় ১৭৫০এর পরে কোম্পানির
খাতা থেকে তথ্য তুলে দেখিয়েছি বাংলা থেকে রপ্তানি হওয়া তিনটি প্রধান পণ্য, মসলিনের
খাসা আর মলমলের দাম কমেছে। চাল বা অন্যান্য খাদ্য শস্যের দামেরও লক্ষ্যণীয় বৃদ্ধি
ঘটে নি। ফলে বাংলায় মধ্যঅষ্টাদশ শতে কোন রকম অর্থনৈতিক সঙ্কট ছিল, একথা বলা যাবে
না।
এটাও বলা দরকার বাংলা বাণিজ্য ক্ষেত্রে
ইওরোপিয়দে আনা দামি ধাতুর পরিমান দেখানোয় কিছুটা অতিকৃত চেষ্টা হয়েছে বলে আমার মনে
হয়েছে। ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকে বাংলা এশিয় এবং ইওরোপিয় উভয় ব্যবসার ক্ষেত্রে
উদ্বৃত্ত অর্থনীতি ছিল – বাংলায় পণ্য কিনতে সব্বাইকে দামি ধাতু নিয়ে আসতে হত। পঞ্চদশ
শতকে জনৈক চিনা ভ্রমনকারী মন্তব্য করেছেন যে, long-distance. merchants -in Bengal
settled· their accounts
with tankas (silver coins)( W.W.Rockhill, 'Notes on the Relations and Trade of
China with the Eastern Archipelago and the Coast of
the Indian Ocefln during the Fourteenth
Century', Toung Pao, 16, pt.2 (1915), p. 144, quoted in Richard
M. Eaton, The
Rise of Islam, p.
96.)। ফলে বাংলায় দামি ধাতু আসা খুব নতুন ব্যাপার
ছিল না। এবং এই কাজে ইওরোপিয়দের ভূমিকা একমাত্র ছিল না এটাও বলা দরকার, একাজে এশিয়
বণিকদেরও বড় ভূমিকা ছিল হয়ত ইওরোপিয়দের থেকেও বেশি। তবে ইওরোপিয়রা যে ভাল পরিমানে
দামি ধাতু আনত এটা অস্বীকার করা যাবে না – কিন্তু অর্থনীতির ওপরে এর প্রাভব খুব সামান্য
ছিল, অর্থনীতির প্রান্তিক ক্ষেত্রটি শুধু এটি ছুঁতে পেরেছিল মাত্র। এই বিপুল
সংখ্যায় দামি ধাতু বাংলায় আসত সেটি ক্ষমতাশালীদের সঙ্গে সওদাগর
মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের ভোগে লাগত।
No comments:
Post a Comment