সাম্প্রতিক কালে বলা হচ্ছে পলাশী চক্রান্তকে(সুশীলবাবু যদিও রেভলুশন কথা টা ব্যবহার
করেছেন) বোঝার জন্য অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে বাংলায় হিন্দু/জৈন ব্যঙ্কিং আর
সওদাগর শ্রেণীর সঙ্গে ব্রিটিশ ব্যবসার সঙ্গে সংযোগকে গভীরভাবে দেখতে হবে। কয়েক
পাতা আগে আমি যাকে হিলের ভুত বলেছিলাম, সেই মানসিকতা যে গবেষকদের মাথা থেকে
বিন্দুমাত্র নামেনি, এই তত্ত্বটা তার প্রকৃষ্ট প্রমান। সম্প্রতিককালে ব্রিজেন কে
গুপ্ত (সুজাউদ্দৌলা বইতে - অনুবাদক) এই তত্ত্ব আমদানি করে বলছেন, ইন্দো-ইওরোপিয়
সামুদ্রিক ব্যবসায় ‘a
community of interest has developed between Hindu mercantile
class and the European Companies' এই শ্রেণী স্বার্থই শেষ পর্যন্ত
ব্রিটিশদের হাতে বাংলাকে তুলে দেয়। সাম্প্রতিককালে আরও বলা হচ্ছে(C.A. Bayly, Indian Society, pp. 49-50, P.J.
Marshall, Bengal,
pp.
65) বাংলার ব্যবসা বিশ্বে ইওরোপিয় ব্যবসার হাত ধরে
বিপুল পরিমানে দামি ধাতু বাংলায় আসতে শুরু করে, যার ফলে বাংলায় ব্যঙ্কিং ব্যবস্থা
আর ইওরোপিয় সওদাগরেরা পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে শুরু করে, ইওরোপিয়
স্বার্থের সঙ্গে বাংলার ব্যঙ্কিং ব্যবসার স্বার্থ জড়িয়ে যায়। এই তাত্ত্বিকেরা আরও
বলার চেষ্টা করেন, বাংলার(উনি লিখছেন ভারতের) ব্যবসায়ী এবং জমিদারদের স্বার্থ
ইওরপিয় স্বার্থের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে বাঁধা হয়ে পড়ছিল, তাই কলকাতা থেকে ব্রিটিশদের
বিতাড়ন ব্রিটিশ বন্ধু, বাংলার ব্যবসায়ী এবং জমিদারেরা মেনে নেয় নি, যার ফল পলাশী
চক্রান্ত (লিখেছেন রেভলুশন) সফল হওয়া। ভারতীয়দের ঐতিহাসিকদের পক্ষ থেকে আসা এই জোট
বন্ধন (কোলাবরেশন) তত্ত্ব আদতে পলাশী চক্রান্তে ব্রিটিশ অংশগ্রহণ অনেকটা লঘু করে
ফেলে(সুশীলবাবু P.J.
Marshall, Bengal,
p.·
77 থেকে উদ্ধৃতি তুলে বলছেন 'By April
it was clear to the British that there was a party pf malcontents in Bengal
led by the Jagat Sei:hs who were prepared to. try to use British power to gain
their ends.' এবং Rajat Kanta Ray ও 'Colonial Penetration and Initial
Resistance', IHR,
vol.
XII, nos. 1-2, p.15. একই কথা বলেছেন)।
ওপরের সিদ্ধান্তে দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপপাদ্য রয়েছে, যাদের বাস্তবতা সম্বন্ধে
সাম্প্রতিক গবেষণা যথেষ্ট প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। প্রথম উপপাদ্য হল পলাশীর আশেপাশের
সময়ে অর্থাৎ ১৭৫৭র আগে আগে বাংলার ব্যবসা জগতে ইওরোপিয় বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণতম চলক
ছিল। এ বিষয়ে সাম্প্রতিক কাজগুলি(আমার ক্ষুদ্র কাজ সমেত) আমাদের এই তত্ত্ব মানতে
আমাদের বাধ্য করে(S.
Chaudhuri, Trade
and Commercial Organization; K.N. Chaudhuri,
Trading World; Om Prakash, Dutch Company)। কিন্তু সাম্প্রতিককালে শিরিন মুসভি এই তত্ত্বকে খারিজ করে জোর দিয়ে
বলেছেন হয়ত বা অবস্থা সম্পূর্ণ আলাদা ছিল, ইওরোপিয়রাই শুধু দামি ধাতু বাংলায় আনত
না, এবং তারাই একমাত্র সব থেকে বেশি দামি ধাতুও আনত না(Shireen Moosvi,
'The Silver Influx, Money Supply, Ptices and Revenue
Extraction in MughaHndia',JESHO, vol. XX~, 1Q87, pp. 92- 94.)। যে কোন সূত্রই আমাদের যে কোন গুণগত তথ্য দিক না কেন, অষ্টাদশ শতকের
চতুর্থ আর পঞ্চম দশকে বাংলায় অবস্থিত এশিয় ব্যাপারীদের ব্যবসার পরিমান মোট ইওরোপিয়দের
এশিয় ব্যবসার তুলনায় অনেক বেশি ছিল। এটাও প্রমান করা যায়, দুটি মূল রপ্তানি পণ্য
সুতিবস্ত্র আর রেশমে, বাংলার এশিয় ব্যবসায়ীদের অংশিদারি, ইওরোপিয়দের তুলনায় অনেক
বেশি ছিল। ফলে আমাদের বলা দরকার ইওরোপিয়দের মতই এশিয়রাও বাংলায় প্রচুর দামি ধাতু
নিয়ে আসত, এবং এই দামি ধাতু দিয়ে ব্যবসা করত, কারণ বাংলা বাজারে এছাড়া কোন পণ্য
কেনা যেত না। ফলে ইওরোপিয়রা বাংলার সব থেকে বড় দামিধাতু আমদানি করত এই ভিত্তিহীন
তত্ত্বের কোন মূল্য নেই এবং ইওরোপিয় বাণিজ্যের ওঠাপড়ার সঙ্গে পলাশী বিপ্লবের সম্বন্ধও
প্রশ্নের মুখে।
দ্বিতীয় উপপাদ্যটাও একইভাবে অনিশ্চিত এবং প্রশ্নবোধক হয়ে রয়েছে, যেখানে বলা
হয়েছে ইওরোপিয় কর্পোরেটদের সঙ্গে বাংলার বণিক আর জমিদারদের ভাগ্য ওতপ্রোত ভাবে
জড়িয়ে গিয়েছিল, এবং যেহেতু পলাশীর আগে ইওরোপিয়রা ছিল বাংলার মুখ্য রোজগার সূত্র, তাই
ইওরোপিয়দের আনা সম্পদের সূত্রে, বা ইওরোপিয়দের সঙ্গে ব্যবসা সূত্রে বাংলার বাণিকদের
ক্ষমতায় আরোহণ। অথচ এর আগে আমরা দেখিয়েছি, বাংলার ব্যবসা জগতে ইওরোপিয়রা
মুখ্যভূমিকায় ছিল না বরং তাদের তুলনায় বাংলার এশিয় সওদাগরেরা বাংলা ব্যবসা
ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছে। ফলে এশিয় বণিকদের ভাগ্য ইওরোপিয় কর্পোরেট বা
সামগ্রিক ইওরোপিয় ব্যবসার সঙ্গে এক সুতোয় ঝুলেছিল এমন কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া
যায় না। আমার এই তত্ত্বকে প্রমাণিত করা যায় বাংলার তখন তিন সব থেকে বড় সওদাগর,
জগতশেঠ, উমিচাঁদ এবং খ্বাজা ওয়াজিদ – এরা তিনজন পলাশী চক্রান্তের গুরুত্বপূর্ণতম
খেলোয়াড়। ১৭৫৭য় লুক স্ক্র্যাফটন হিসেব দিয়ে বলছেন, জগতশেঠ পরিবারের বাৎসরিক আয় ছিল
৫০ লক্ষ টাকা, যার মধ্যে কোম্পানির বাংলায় আনা দামিধাতু থেকে মুদ্রা তৈরির বাটা
এবং ইওরোপিয় কোম্পানিগুলোকে দেওয়া ধারের সুদ সূত্রে রোজগার হত খুব বেশি হল ১৫ লক্ষ
টাকা। এর পরে কি করে আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি জগতশেঠের গদির ভাগ্য নির্ভর করত
একমাত্র ইওরোপিয়দের আনা দামি মুদ্রার বাটার ওপরে! একইভাবে উমিচাঁদ এবং খ্বাজা
ওয়াজিদ যদিও ইওরোপিয় ব্যবসার সঙ্গে অনেক গভীরভাবে যুক্ত ছিল, কিন্তু তাদের মূল
রোজগার ছিল বাংলার নুন আর সোরার একচেটিয়া ব্যবসা থেকে। এছাড়াও উমিচাঁদ আফিম এবং
শস্য ব্যবসায় হাত দেন আর খ্বাজা জড়িয়ে ছিল সুরাট, লোহিত সাগর এবং পারস্য উপসাগরীয়
ব্যবসায় তার নিজের বিপুল বাণিজ্য বহর নিয়ে। এইসব উদাহরণে আমাদের ধারণা হয় না যে বাংলার
ব্যবসা সংগঠন কোনভাবে ইওরোপিয় ব্যবসার সংগঠনের ভাগ্যের সঙ্গে সমানুপাতিকহারে
জড়িয়েছিল।
No comments:
Post a Comment