রণবীর চক্রবর্তী
বিনিময় মাধ্যম
টাঁকশাল থেকে ছাপা হয়ে বেরিয়ে আসা ধাতুমুদ্রার যুগের আগে আমাদের আলোচ্য সময়ে
তৃতীয় খ্রিষ্টপূর্বের পূর্বে মূলত পণ্যই বিনিময় মাধ্যম হিসেবে কাজ করত। উত্তরভারতে
ষষ্ঠ খ্রিষ্টপূর্ব এবং বাংলার বিভিন্ন বানিজ্য কেন্দ্র যেমন মহাস্থানগড়, বানগড়,
চন্দ্রকেতুগড়, মঙ্গল্কোট, তাম্রলিপ্তি ইত্যাদিতে তৃতীয় খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ছাপা
মুদ্রার( punch-marked coins) আবির্ভাব লক্ষ্য করা যায়। সম্প্রতি উয়াড়ি-বটেশ্বরে
ছাপা মুদ্রা পাওয়া যাওয়ায় এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে সেই পূর্ব বঙ্গবদ্বীপ
অঞ্চলেও অর্থমাধ্যমে ব্যবসা হত এবং এই ব্যবসার রমরমা ছিল। রৌপ্য মুদ্রা কার্ষাপণ
মাপকে ছিল ৩২ রতি বা ৫৭.৬ গ্রেন।
তৃতীয় খ্রিষ্টপূর্বে বাংলায় মুদ্রার ব্যবহারের অর্থ হল তার আগেই বাংলা ব্যবসা
বিশ্ব বিপুলভাবে প্রবেশ করেছে। শিলালেখতে উল্লিখিত পুণ্ড্রনগরে কোসাওর মুদ্রাকোষ
গণ্ডা আর কাকিনি দিয়ে ভরার অর্থ করছেন কিছু গবেষক, যে এই দুটি ধরণের মুদ্রার প্রচলন
ছিল সে সময়। অন্য এক দল গবেষকের বক্তব্য গণ্ডা, মাপ আদতে কড়ির সংখ্যার বর্ণনা।
দ্বিতীয় ধারনা ধরে এগোলেও আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের আলোচ্য সময়ে কিন্তু পণ্য
বিনিময় মাধ্যম ছিল কোন অন্য মাধ্যম। সেটা কিন্তু কড়িই। তৃতীয় খ্রিপূতে রূপোর ছাপা
মুদ্রার পাশাপাশি দ্বিতীয় খ্রিপূতে তামা আর সোনার(বুলিয়ন) মুদ্রাও চালু হয়। গোটা
এককের মুদ্রার পাশাপাশি অর্ধ এবং একচতুর্থাংশ এককের মুদ্রাও পাওয়া গিয়েছে। এই uninscribed তামার মুদ্রার ভিত্তি ছিল রূপোর কর্ষাপণ। Die-struck মুদ্রার আবির্ভাব বাংলায় হয় কুষাণ আমলে। নিম্ন
রাঢ় এবং বঙ্গে দ্বিতীয় খ্রি সময়ে ছাপা তামার মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে – এগুলির নাম
দেওয়া হয়েছে কুষাণ-রাঢ/কুষান-বঙ্গ মুদ্রা এবং এগুলি ওডিসায়(কলিঙ্গ) আবিষ্কৃত
পুরী-কুষাণ মুদ্রার অনুরূপ। এর থেকে আমরা আরেকটি সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে
বঙ্গ-কলিঙ্গ একই ব্যবসা শৃঙ্খলায় যুক্ত ছিল।
পঞ্চম এবং ষষ্ঠ শতকের প্রথমপাদে রাজনৈতিকভাবে গুপ্ত সাম্রাজ্যের বাংলায়
উপস্থিতির ফলে এই অঞ্চলে গুপ্ত আমলে মুদ্রার প্রাদুর্ভাব ঘটে। এবং এই মুদ্রাগুলির আঙ্গিক
অসাধারণ চমৎকার। উত্তরবঙ্গে আবিষ্কৃত বহু গুপ্ত তাম্রলিপিতে এই সময়ের ম্যুদ্রার
নাম পাওয়া যায় – দিনার এবং রূপক। এই দুই শব্দের অর্থ হল গুপ্ত যুগের সোনা আর রূপোর
মুদ্রা। এই তাম্রশাসনগুলি থেকে কয়েকটা বিষয় পরিষ্কার হয় যে ১টি গুপ্ত সোনার
মুদ্রার বিনময়ে মিলত ১৫-১৬টা রূপোর মুদ্রা - রূপক। গুপ্ত যুগের সোনার মুদ্রার ওজন
ছিল ১২৪ গ্রেন; স্কন্দগুপ্তের সময় বেশ ভারি ১৪৪ গ্রেনের সোনার মুদ্রার আবির্ভাব
ঘটে। এগুলির নাম হয় সুবর্ণ। পরে নরসিংহ গুপ্ত বালাদিত্যের সময় এই সুবর্ণগুলির ওজন
কমানো( debased) হয়। সুবর্ণর অনুরূপ সোনার মুদ্রা পাওয়া যায় শশাঙ্কের পূর্বে ৬০০ খ্রি এবং
তার সময়েও(৬০০-৩৭?খ্রি)। সমতটের শাসকের মুদ্রার অনুরূপে সপ্তদশ অষ্টাদশ শতের এই
সোনার মুদ্রার পরিকল্পনা করা হয়। সুবর্ণর গুণগত মানের এই স্বর্ণমুদ্রায় সোনার
পরিমান বেশ কম। এর পরে চার বা পাঁচ শত ধরে বাংলার আর্থব্যবস্থায় আর কোন সোনার
মুদ্রার খোঁজ পাওয়া যায় না।
৭০০ থেকে ১২০০ সাল পর্যন্ত বাংলায় জটিল আর্থ ব্যবস্থা লক্ষ্য করা যায়। একটা
বিষয় লক্ষ্য করার মত যে পাল আর সেন রাজত্বে নতুন কোন মুদ্রা লক্ষ্য করা না গেলেও
সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত সমতট-হরিকেল অঞ্চলে বিপুল পরিমানে উচ্চগুণমানের
রূপোর মুদ্রার প্রচলন ছিল(যদিও কোন রাজত্বে প্রচলিত হয়েছিল তার কোন উল্লেখ পাওয়া
যাচ্ছে না এই মুদ্রাগুলি থেকে)। দীর্ঘ দিন ধরে মুদ্রায় দামি ধাতুর গুণমান বজায়
রাখার চেষ্টা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার, এই অঞ্চলে দীর্ঘকাল ধরে বিপুল ক্ষমতাধর কোন
শাসক রাজত্ব করেছে কর্তৃত্ব নিয়েই। এগুলি প্রখ্যাত মুদ্রা পুরাণ এবং দ্রম্মের
গুণমানের ৫৭.৬ গ্রেন ওজনের। এই দুই মুদ্রার উল্লেখ আমরা কিন্তু পাল আর সেন
রাজত্বের তাম্রসাসনে পাচ্ছি। দশম শতের পর থেকে হরিকেলের মুদ্রা হাল্কা হল কিন্তু তার
ব্যসার্ধ বাড়ে চওড়া হল এবং তার এক দিকে ছাপা থাকত। হরিকেলের মুদ্রা ছাপার
পরিবর্তনের মধ্যে সুষ্পষ্টভাবে আরব মুদ্রা ব্যবস্থার প্রভাব বর্তমান। এর থেকে
বাংলার উপকূলের আরবের ব্যবসার যোগসূত্র প্রমানিত হয়। বাংলার উপকূলের সঙ্গে আরবের
ব্যবসার আরও সূত্র পাওয়া যায় অষ্টম শতে হারুনঅলরশিদ, দ্বাদশ শতের মুস্তাসিম
বিল্লার রাজত্বের মুদ্রা ময়নামতি এবং পাহাড়পুরে প্রত্নতত্ত্ব খননে উদ্ধার হওয়ায়।
বহু গবেষক যে বলেছেন সামন্ততন্ত্রের প্রভাবে বাংলার উপকূল অঞ্চলে বহির্বাণিজ্যে ভাটার
টান দ্যাখা যায়, এই সব মুদ্রা বিপুল সংখ্যায় পাওয়া যাওয়ায় সেই তত্ত্ব খারিজ হয়ে
গিয়েছে। জমিদানলিপি আর মুদ্রা ব্যবস্থা পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল ছিল না হয়ত, কিন্তু
কিছু অঞ্চলে তারা পাশাপাশি অবস্থা করত। পুরাণ আর দ্রম্মর মত রূপোর মুদ্রার সঙ্গে
১২৮০টি কড়ির সরল সহজ এবং সাধারণ বিনিময়যোগ্যতার উদাহরন পাচ্ছি সেই সময়ের অঙ্কের
ধারাপাতে। সেন আমলে চুর্ণির ব্যবহারের উল্লেখ পাচ্ছি যা কর্পর্দক আর কড়ির
মধ্যবর্তী বিনিময় মাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত হয়। এর থেকে প্রমান হয় চুর্ণি বা/অথবা কপর্দক-চুর্ণি
বিনিময় মাধ্যম হিসেবেই কাজ করেছে।
No comments:
Post a Comment