পলাশীর কিছু আগে বাংলার হিন্দু সমাজে দুই বর্ণ – ব্রাহ্মণ ও শূদ্র। দুই বর্ণে মিলিয়ে ছত্রিশ জাতি বলছেন গঙ্গারাম ‘মহারাষ্ট্র পুরাণ’এ(হান্টার, এনালস...)। দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতক থেকেই বাংলার বর্ণ বিন্যাস বোঝা যায় বৃহদ্ধর্মপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ-এ। বৈদ্য/অম্বষ্ঠ এবং করণ বা কায়স্থরা ব্রাহ্মণের নিচে ছিলেন। পুরাণ অনুসারে এরা সৎ শূদ্র বা উত্তম শঙ্কর। নবদ্বীপের স্মার্ত রঘুনন্দন যিনি বাংলার ক্রিয়াকর্ম, পূজা, পার্বন, বিবাহের নানান নিদান দিয়ে যান, তিনিও বৈদ্য কায়স্থদের শূদ্র বর্ণে অন্তর্ভূক্ত করেছেন। দুশ বছর পর ক্রমশঃ বৈদ্য আর কায়স্থরা আস্তে আস্তে স্বতন্ত্র স্তর হিসেবে উঠে আসতে শুরু করছে – স্ববর্ণের বণিক আর কারিগরদের থেকে বেশ কিছু দূরে সরে যান তাঁরা।
তবুও শূদ্ররা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এদের তিন ভাগ – উত্তম সঙ্কর –মধ্যম সঙ্কর বা জলঅচল শূদ্র আর অন্তজ অস্পৃশ্য শূদ্র। বৈদ্য, কায়স্থ আর নবশাখেরা হল উত্তম সঙ্কর। নবশাখেরা হল গোপ, মালী, তাম্বুলী, তাঁতি, শাঁখারী, কাঁসারী, কুম্ভকার, কর্মকার ও নাপিত। গঙ্গারাম আর ভারতচন্দ্র উভয়েই নবশাখেদের কথা উল্লেখ করেছেন। ব্রাহ্মণেরা এদের বাড়িতে পুজোপাঠ করত বা জল খেত। এদের নিচে ছিল মধ্যম সঙ্কর – কৈবর্ত, মাহিষ্য, আগুরি, সুবর্ণ বণিক, সাহা শুঁড়ি, গন্ধ বণিক, বারুই, ময়রা, তেলি, কলু, জেলে, ধোপা ইত্যাদি। অধম সঙ্কর জাতি হল যুগি, চণ্ডাল, নমঃশূদ্র, পোদ, চামার, মুচি, হাড়ি, ডোম, বাউরি, বাগদি ইত্যাদি। মধ্যম শঙ্করদের সঙ্গে এদের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল না।
এদের মধ্যে আবার প্রচুর স্তরভাগ – ‘সামাজিক কাঠামোয় একটি বিশেষ স্তরে অবস্থান, একটি পারিবারিক বৃত্তি বা পেশা অবলম্বন এবং বিবাহ ও খাদ্যাভ্যাসসহ কতকগুলি সামাজিক নিয়ম কানুন মেনে চলা। এই সাধারণ জাতি বৈশিষ্ট্যগুলি মেনে চলা সত্ত্বেও এই জাতিগুলির মধ্যে পার্থক্য ও বিভেদ লক্ষ্য করা যায়। ব্রাহ্মণেরা পাঁচ শ্রেণীতে বিভক্ত – রাঢী, বারেন্দ্র, বৈদিক, সপ্তশতী ও কান্যকুব্জ। বৈদ্যরাও পাঁচ গোষ্ঠী – উত্তর রাঢী, দক্ষিণ রাঢী, বারেন্দ্র, বঙ্গজ ও পূর্বকূল। কায়স্থদের মধ্যে ছয় ভাগ উত্তর রাঢী, দক্ষিণ রাঢী, বারেন্দ্র, বঙ্গজ, শ্রীহট্টবাসী ও দাসকায়স্থ। কৌলিন্যে ব্রাহ্মণেরা পাঁচ ভাগে বিভক্ত – কুলীন, শ্রোত্রীয়, গৌণকুলীন, বংশজ, সপ্তশ্তী গোষ্ঠী। দেবীবর ঘটক কুলীন ব্রাহ্মণেদের মধ্যে দোষানুসারে ছত্রিশটি মেল বন্ধন সৃষ্টি করেন (জাতিভেদ প্রথা ও উনিশ শতকের বাঙ্গালি সমাজএ দোযান মেলয়রীতি মেল প্রবন্ধ, অমিতাভ মুখোপাধ্যায়)। নির্মল বসু বলছেন, বৃত্তিমূলক বর্ণ সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল প্রতিযোগিতাহীন উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। বর্ণ বা জাতি সেই গোষ্ঠীর লোকেদের জন্য জোবিকা নিরাপদ ও নিশ্চিত রাখত। এই কারণেই বর্ণ ও জাতিভিত্তিক সমাজ যুগ যুগ ধরে চলল এবং এমনকি মুসলমানেরাও এদিকে কিছুতা ঝুঁকল(নির্মল বসু, এম কে চৌধুরী সম্পাদিত সোসিও ইকনমিক চেঞ্জ ইন ইন্ডিয়ায় উদ্বোধনী ভাষণ)।
ভারতচন্দ্র ও গঙ্গারাম, বর্ণ ও জাতিভিত্তিক অনেক পেশার পরিচয় দিয়েছেন। ব্রাহ্মণ সাধারণত বেদ, ব্যাকরণ, স্মৃতি, ন্যায়, দর্শনচর্চা, আর পুজার্চনা নিয়ে থাকতেন। ব্রাহ্মণ করণিকের কাজ করবেন অসুবিধে হলে, কিন্তু সেনাবাহিনীতে নাজির বা জমাদারের কাজ বা কূটনৈতিক কাজ করত না। বৈদ্যরা চিকিতসাই করত। কায়স্থরা একচেটিয়া করণিক – রাজস্ব বিভাগে বা প্রশাসনে তাদের পদ রাখা থাকত। সিরাজ পর্যন্ত নবাবেরা কায়স্থদের রাজস্ব আদায় ও প্রশাসনে ব্যাপক হারে নিযুক্ত করেছেন।
নবশাখেরা ব্যবসায়ী কারিগর – তাম্বুলি তিলি ও গোপ ব্যবসায়ী আর শাঁখারী, তাঁতি, মালাকার, কুম্ভকার, কর্মকার, নাপিত। দ্বিতীয় শ্রেণীর শূদ্ররা চাষ-আবাদ ও ব্যবসায়ে নিযুক্ত। অন্যরা তেল তৈরি করা, মাছ ধরা, কাপড় কাচা ইত্যাসি জাতিগত বৃত্তিধারী। অন্তজরা চাষী, শ্রমিক, পশুপালক, শিকারী, লাঠিয়াল, পাইক, বরকন্দাজ ইত্যাদি।
পলাশীর আগের সময়ে হিন্দুদের সমস্ত বর্ণ ও জাতের মধ্যে বৃত্তি পরিবর্তনের ঝোঁক দেখা যায়। বেশ কিছু ব্রাহ্মণ জমিদার পরিবার তৈরি হয় নবাবী আমলে – নাটোর(রামজিবন, রামকান্ত, রানী ভবানী), ময়মনসিংহের শ্রীকৃষ্ণ হালদার, মুক্তাগাছার বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরী বড় জমিদার। রাজশাহী, তাহিরপুর, পুথিয়া ইত্যাদিতে ব্রাহ্মণ ছোট জমিদার বা ভুঁইয়া ছিল। ভারতচন্দের পিতা নরেন্দ্রনাথ রায় ভুরসুট পরগণার পাণ্ডুয়াতে জমিদার ছিলেন(রায় বা হালদার কি করে, কোন অঙ্কে ব্রাহ্মণ হয় জানি না – হয়ত যে করে পশুপালক নন্দরা ব্রাহ্মণ হয়)। ব্রাহ্মণ কায়স্থরা প্রশাসনে ছিলেন। আবুল ফজল কায়স্থদের জমিদার বলে উল্লেখ করেছেন। সামাজিক প্রতিপত্তিতে এবং বাংলার দরবারী রাজনীতিতে এরা জমিদারদের থেকে অনেক উঁচুতে।
বৈষ্ণবদের মধ্যে বহু অব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণদের দীক্ষা দিত। নবসাখদের মধ্যে তাম্বুলিরা ব্যবসা করত। জমিদারিও কিনেছে। রানাঘাটের পালচৌধুরী পরিবারের কৃষ্ণচন্দ্র পান্তি ছিলেন তাম্বুলি। তার জমিদারি কেনায় রামপ্রসাদ গেয়েছিলেন – ঐ যে পান বেচে খায় কৃষ্ণ পান্তি তারে দিলে জমিদারি। দীঘাপাতিয়ার দয়ারাম রায় ছিলেন তিলি। ক্ষত্রিয়ের কাজ করত গোয়ালা, বাগদী, হাড়ি, ডোম। সুবর্ণবণিকদের অনেকেই বেনিয়ান মুৎসুদ্দি, সরকার, গোমস্তা হিসেবে কাজ করেছে। ফলে পলাশীর আগে বৃত্তি পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে নিয়মিতভাবে।
No comments:
Post a Comment