১৭২৮/১১৩৫এ সুজাউদ্দিন মুর্শিদকুলির ব্যবস্থা একটু পরিবর্তন করেন। জমিদারেরা কড়া নবাব মুর্শিদকুলির হাত থেকে বাঁচল। খালসা জমি থেকে ১০৯১৮০৮৪ টাকা আর জাগির জমির রাজস্ব ৩৩২৭৪৭০ টাকা নির্ধারিত হল। এর পর থেকে মোটামুটি ভূমি রাজস্ব একই থাকবে।
মুর্শিদকুলি দেওয়ানি দপ্তরের মুৎসুদ্দি আর হিসেব রক্ষকদের জন্য ওয়াজাসাৎ খাসনবিশি খাতে একটু বাড়তি ভূমি রাজস্ব চাপিয়েছিলেন যার নাম আবওয়াব, পরিমান ছিল ২৫৮৮৫৭টাকা। চার খাতে সুজা চাপালেন ১৯১৪০৯৫ টাকা – এগুলো হল – ১) নজরানা মোকরারি – দিল্লীতে বাদশাহী রাজস্ব পাঠানো খরচ – ২৪৮০৪০ টাকা, ২) জার মাথোট – পুণ্যাহ, নজর, খেলাৎ, বাঁধের খরচ ও রসুম নেজরাৎ অর্থাৎ প্রধান পিয়নের মফঃস্বল থেকে রাজস্ব আনার খরচ ১৫২৭৮৬ টাকা, ৩) মাথট ফিলখানা – নাজিম দেওয়ানের হাতির খরচ ৩২২৬৩১ টাকা আর ৪) ফৌজদার আবওয়াব সুদূর সীমান্তের ফৌজদারি কর ৭৯০২৩৮ টাকা।
এর ওপর আলিবর্দি আরও চারটি আবওয়াব বসিয়েছিলেন ১) চৌথ মারাঠা –১৮৫১য় আলিবর্দী নাগপুরের রঘুজী ভোঁসলেকে রাংলার রাজস্ব থেকে বছরে ১২০০০০০ টাকা চৌথ দিতে সম্মত হন। সেই প্রতিশ্রুতিতে তিনি খালসা জমিতে রাজস্ব বাড়িয়েছিলেন - ১৫৩১৮১৭ টাকা, ২) আহুক হল শ্রীহট্ট থেকে জনহিতকর কাজের জন্য আনা চুনের খরচ ১৮৪১৪৭ টাকা ৩) কিসমত খেস্ত গৌড় – হল গৌড়ের প্রাসাদ ভেঙ্গে ইট আনার খরচ মেটানোর রাজস্ব - ৮০০০ এবং ৪) নজরানা মনসুরগঞ্জ – সিরাজের প্রাসাদ, হীরাঝিলের কাছে মনসুরগঞ্জ বাজারে আর তার পাশের জমিদারির ওপর রাজস্ব- ৫০১৫৯৭ টাকা। সব মিলিয়ে ২২২৫৫৫৪ টাকা।
বাংলার জমিদারেরা নবাবের ওপর আনুপাতিক হারে আবওয়াব বাড়ালেন, স্বাভাবিকভাবে রায়োতদের ওপর চাপ বাড়ল। ১৭৮৯/১১৮৬ সালে তার মিনিটে জন শোর এই আবওয়াব সম্বন্ধে কঠোর মন্তব্য করেন, বাংলার কৃষি সম্পদের ওপর এই বাড়িতি কর বহন করা খুব একটা কঠিন ব্যাপার ছিল না। কিন্তু এ ধরণের বাড়তি কর বহন করা জমিদার আর রায়ত উভয়দের পক্ষেই ক্ষতিকর। এ ধরণের করের প্রবণতা জমিদারদের বলপ্রয়োগে অধিক রাজস্ব আদায়ের দিকে ঠেলে দেয় এবং সমস্ত ব্যবস্থা, গোপনতা এবং দুর্দশা সৃষ্টি করে।
এ প্রসঙ্গে বলে নেওয়া ভাল বাংলা লুঠের দস্যু ইংরেজদের নবাবী আমলকে সমালোচনা করা কঠিন কঠোর সুকরুণ বিকৃত হাস্য রসের সৃষ্টি করেছে। জন শোরের বা ফার্মিঙ্গারএর মত ব্রিটিশ উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী নবাবী আমলের রাজস্ব বৃদ্ধির সমালোচনাকে নিঃশর্তে গলার্ধকরণ করেছেন বাংলার তাবড় তাবড় ঐতিহাসিক। বাঙ্গালি ঐতিহাসিকেরা তাঁদেরকে খুব বাহবাও দিয়েছেন মুসলমান প্রশাসকদের এই কাজের সমালোচনার জন্য। নতুন সহস্রাব্দে লুঠের ভরকেন্দ্রে বসে আমরা যারা বাংলার পক্ষে ব্রিটিশ লুঠের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে সে সময়টা দেখছি, তারা মনে করি সুজা বা আলিবর্দি রায়তদের ওপর অতিরিক্ত আবওয়াব চাপিয়ে অবশ্যই গর্হিত কাজ করেছিলেন সন্দেহ নেই, কিন্তু সত্যিকারের নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখলে এই বৃদ্ধি সে সময়ের উদ্বৃত্ত অর্থনীতির বাংলার রায়তেরা সহজেই আত্তীকরণ করতে পেরেছিল। সব থেকে বড় কথা নবাবেরা এই অতিরিক্ত বৃদ্ধির অর্থ নিজেদের দেশে লুঠে নিয়ে যেতে চান নি, এই অর্থটার একটা বড় অংশ বাংলাতেই থেকে গিয়েছিল। পলাশীর পরে মির্জাফরের পর মিরকাশিমের সময় থেকে বাংলার রাজস্ব দুয়ে লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজস্ব বৃদ্ধির যে উড়ান শুরু হল, বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেমন নুনের ওপর বিপুলতম শুল্ক বসে যে লুঠের রাজত্ব শুরু হল, তাতে ইংরেজদের সুজা বা আলিবর্দি খাঁয়ের রাজস্ব বৃদ্ধির সমালোচনা যেন চালুনি সূঁচএর ফুটোর সমালোচনা খোঁজা।
মুঘল কর ব্যবস্থায়, আমরা আগেই বলেছি ভূমি রাজস্ব ছাড়া আর সব ধরণের শুল্ক বা করকে অস্থায়ী বলে মনে করা হত। ভূমি রাজস্ব ছাড়া সব ধরণের শুল্ক বা করকে সায়ের বলা হত। আইনি আকবরিতে সায়েরের একটা দীর্ঘ তালিকা দেওয়া আছে। নবাবী আমলে বাংলার শিল্প, বাণিজ্যের প্রবল উন্নতি আর বিদেশি কোম্পানিগুলি বিপুল বাণিজ্য এই সায়ের সংগ্রহে নবাবাদের প্ররোচিত করে। মুর্শিদ কুলির সময় থেকেই সায়ের সংগ্রহে একজন করে ভারপ্রাপ্ত দারোগা ছিলেন। তিনি কর আদায়ের দায়িত্বে – তার অধীনে আমিন চৌকিয়ৎ নামে একজন শুল্ক চৌকির প্রধান হিসেবে কাজ করত। এই কর ধার্য করা হত বাড়ি, ঘর, দোকান, বাজার, গঞ্জ, মদ, আমদানি-রপ্তানি দ্রব্য গুদাম, কুঠি, ফেরিঘাট ইত্যাদির ওপর। মেলা থেকে শুল্ক তোলা হত। লাইসেন্স ফি, সেতু ইত্যাদি শুল্কের আওতায় পড়ত। শতকরা হার ছিল আড়াই শতাংশ। নবাবেরা মুসলমান বণিকদের থেকে আড়াই আর হিন্দু বণিকদের ওপরে সাড়ে তিন শতাংশ হারে বাণিজ্য পণ্য মাশুল লাগু করেছিলেন।
হলওয়েল জানাচ্ছেন সুজা সায়ের কর চাপানোর জন্য সারা বাংলায় কুড়িটি চৌকি স্থাপন করেছিলেন। গ্রান্টের প্রতিবেদনে জানান যায় মুর্শিদাবাদ আর বক্সী বন্দর হুগলি থেকে বেশ কিছু অর্থ আদায় করা হয়েছে। এক বছরে রাজধানীর সায়ের(সায়ের চুণাখালি) আদায় হয়েছিল তিন লক্ষ এগারো হাজার ছশ তিন টাকা আর ঐ সময়ে হুগলি থেকে আদায়ের পরিমান দুলক্ষ সাতানব্বই হাজার নয়শ একচল্লিশ টাকা।
No comments:
Post a Comment