ধনীদের বাড়ি, চণ্ডীমণ্ডপ বা গুরুর বাড়িতে পাঠশালা বসত। ছাত্ররা পাততাড়ি মানে তাল পাতা বা খেজুর পাতার চাটাই নিয়ে আসত বসার জন্য – যে জন্য আজও বাংলায় পাততাড়ি গোটানো লব্জটার চল রয়েছে আজও, যেভাবে তাঁতের টানাপোড়েনের মত প্রাযুক্তক লব্জটা অবলীলায় ঢুকে গেছে বাংলা শব্দভাণ্ডারে। যেহেতু আলাদা পাঠশালার জন্য বিপুল বিশাল চোখ কপালে তুলে দেওয়া কাঠামো তৈরি নিয়ে গাঁইয়াদের আজও কোন বদ্ধসংস্কারাবেশ নেই, তাই প্রয়োজনে বড় গাছের তলাতেই পাঠশালা বসত। কি পড়ানো হত তা নিয়ে আগেই আলোচনা করা গিয়েছে, তাও বলা যাক নতুন করে, কর্পোরেট/রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন দমিয়ে রাখতে পারে নি সামাজিক/স্থানিক প্রয়োজনকে।
সুলতানি আমলে আগে বৌদ্ধ পন্থের প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য তৈরি করা হত শিক্ষক, ঠিক যে জন্য বৌদ্ধ বাইওয়ালা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মশাই এক লব্জে গুরু নাঢপাদের বয়ানে বলে দিতে পারেন তিব্বতি রাজার ডাকে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বাংলা ছাড়লে ভারত অন্ধকার হয়ে যাবে।
হরপ্রসাদ আমাদের অন্ততম প্রিয় বাংলাবিদ। তথাচ, তাঁর মত রাষ্ট্রবাদী ঐতিহাসিক কোন দিনই বাংলার গাঁইয়াদের কেন্দ্রহীন পড়াশোনাকে আলোচনার যোগ্য বলেই মনে করেন নি। অতীশ বাংলা ছাড়লে সত্যিকারে কয়েক দশকের মধ্যে মাটিতে মিলিয়ে যায় বৌদ্ধ রাষ্ট্র প্রণোদিত শিক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু টিকে থাকে গাঁইয়া কেন্দ্রবিহীন পাঠশালা, চাটশালা, যতদিননা গাঁইয়াদের ওপরে বলপ্রয়োগ করে, নবজাগরণের অগ্রদূতেদের লেলিয়েও দিয়ে বাংলার মাটিতে অগ্রগতি সমান পশ্চিম প্রযুক্তির জ্ঞানচর্চা সমান কর্পোরেটবাদের এই চেষ্টাকৃত অপিনিহিতিটা শেখানো যায় নি।
মনে রাখতে হবে অঞ্চলভিত্তিক বিকেন্দ্রিভূত উৎপাদন ব্যবস্থা আর বিশাল উদ্বৃত্ত বিপুল বাণিজ্য চালানোর কাজে যেমন ব্যপ্ত দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন ছিল, তেমনি প্রয়োজন ছিল বিশাল জ্ঞানচর্চার পরিবেশের। যারা বলছেন শুধুই জমিদারির খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে তৈরি হয়েছিল এই পাঠ দান, তারা হয় গাঁইয়াদের খিস্তিকারী মার্ক্স অনুগামী, নয় লুঠেরা ঔপনিবেশিক। এরা অধিকাংশ চাকুরে বিদ্যাজীবি, এরা জানেন না ব্যবসা, বোঝেন না তার কাঠামো।
এর আগে আলোচনা করেছি, বাংলা শুধু যে প্রচুর শিল্প আর কৃষিদ্রব্য উৎপাদন করত না, বহু বিশ্ব উৎপাদন পরিবহনের মধ্যমণি ছিল – অর্থাৎ বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক পণ্য বাংলায় এসে বিভিন্ন দেশে নতুন করে যেত – যেমন তুর্কি ঘোড়া বা মলদ্বীপের কড়ি, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মশলা, দক্ষিণ ভারতে আর গুজতাটের কাপড় ইত্যাদি। এই সব দ্রব্য স্বল্প সময়ের জন্য গুদামজাত করা, বিভিন্ন দেশে পাঠাবার পরিকল্পনা করা, জাহাজে তোলা, জাহাজ চালানো, শুল্ক হিসেব করা, পরীক্ষা করা, বীমা করা ইত্যাদির জন্য বিপুল জ্ঞানচর্চাভিত্তিক কর্মী লাগত। এবং চন্দ্রকান্ত রাজু বলছেন ভারতে কলণবিদ্যা শিখত দুধরণের মানুষ, ১) চাষী আর ২) নাবিক, এবং ভারতে কলনবিদ্যা ছিল প্রাথমিক বা মাধ্যমিকস্তরের পাঠ্য, না বুঝে চোলাই করে ইওরোপে গিয়ে নিউটন আর লিবনিতজএর হাতে পড়ে সেটা হয়ে গেল উচ্চতর বিদ্যার বাহন। তো তখন ভৃগুরাম দাসের শুভঙ্করী ইত্যাদি বিষয় আগেই আলোচনা করেছি এডামের শিক্ষা ব্যবস্থা বিশ্লেষণে। পড়া, লেখা, অঙ্ক করা ইত্যাদি দিয়েই পাঠশালার প্রাথমিক কাজ শেষ হত।
পাঠশালা ছাড়া ছিল তোলবাখানা। এর একটা উদাহরণ পাচ্ছি দীনেশচন্দ্র সেন টিপিক্যাল সিলেকশন্স ফ্রম ওল্ড বেঙ্গলি লিটারেচার থেকে, সমশের গাজি(ত্রিপুরার রোশনাবাদ পরগনার কৃষক বিদ্রোহের নায়ক) পরিচালিত তোলবাখানা থেকে। সমশের গাজি আরবি, ফারসি আর বাংলা শেখানোর জন্য ১০০ ছাত্র রেখেছিলেন। ভারতের অন্য এলাকা থেকে আরবি শিক্ষক, ঢাকার কাছের জগদিয়া থেকে বাংলা পণ্ডিত আর ঢাকা থেকে ফারসী মুন্সী এনেছিলেন।
এছাড়াও ছিলেন বহু ভ্রাম্যমান শিক্ষক – সুফি, দরবেশ, ফকির, ব্রাহ্মণ ঠাকুর, বৈষ্ণব সহজিয়া, আউল, বাউল, কর্তাভজা প্রমুখ মানুষ যারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষদের ধর্ম, জীবনযাপন, নৈতিকরা, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে উপদেশ দিতেন, ঈশ্বর আছেন কি নেই, সাম্য, ন্যায়ের পক্ষে প্রচার চালাতেন। আর রয়েছে গ্রামের গান বাজনা নাটক অভিনয় ইত্যাদি, যেগুলো পরোক্ষভাবে পরম্পরার কর্পোরেট বিরোধী সমাজভিত্তিক শিক্ষাদানের বাহন। গ্রাম বাঙালির মানস গড়নে এই মানুষ/শিল্পের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। অনাথ লালন বিদ্যালয় না গিয়েও লালন ফকিরে রূপান্তরিত হলেন কি করে সে, গুপ্ত কিন্তু সামাজিক জ্ঞান আধুনিক প্রগতিশীল লেখককুলও বুঝতে পারেন নাই, কারণ তারা বিদ্যা বলতে বিদ্যালয়ের চার দেওয়াল ঘেরা বেত্রহস্তে অথবা ঠাণ্ডা ঘরে বিচিরিত মাস্টারমশাই ছাড়া প্ন্যকোন পাঠের কথা জানেন না, বোঝেন না, বুঝলেও পাশ্চাত্যের অনুগামিতায় বলেন না।
ঠিক এই রকমভাবে গুপ্ত ছিলেন গ্রামের শিল্প বংশপরম্পরায় চলা কারিগর আর তাদের কারখানাগুলির কাঠামো ভিত্তিক হাতে কলমে শিক্ষা ব্যবস্থা, যে শিক্ষা ব্যবস্থার নথি করণের কোন চেষ্টাই ইওরোপমন্য শিল্লহা ব্যবস্থার ইতিহাসে মন দিয়ে করা হয় নি – কারণ তার অবিদ্যালয়সুলভ শিক্ষা দানের কাঠামো। কারিগর তার চ্যালাকে তার শেখা বংশ পরম্পরার জ্ঞান আর প্রজ্ঞা দিয়ে যান শিক্ষানবিশী কালে। চ্যালা সেই জ্ঞান গুরু/মুরিদ/হুজুরগৃহে দীর্ঘদিন থেকে শিখে নিজেই কারিগর হয়ে ওঠে সময়ের হস্তাবলেপনে। এই শিক্ষা ব্যবস্থার রেশ পলাশীর পরের লুঠ, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর আর চিরিস্থায়ী বন্দোবস্তের কৃষকদের হাত থেকে জমি লুঠ, সম্পদ লুঠের দুশ, সোয়াদুশ বছর পরে আজও চিরভাস্বর।
No comments:
Post a Comment