বাংলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডাচেরাই ছিল ব্রিটিশদের প্রতিদ্বন্দ্বী। ডাচেরা যে বিপুল অর্থ নিয়ে আর কূট বাণিজ্য বুদ্ধি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিল তা বহুকাল ব্রিটিশদের দমিয়ে রেখেছিল। বাংলায় ব্রিটিশদের একটু পরে যাত্রা শুরু করেও, সমস্ত ব্যবসায়িক এবং শিল্পপ্রধান এলাকায় তাদের কুঠী ছিল। এবং ১৭৫৭র কিছু আগে পর্যন্ত ব্রিটিশদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারা বাংলার পণ্য কিনত। এবং ইওরপিয় কোম্পানিগুলোর মতই তারা বিভিন্ন এলাকায় লুঠপাট চালিয়ে যে সোনারূপো দখল করত সেগুলি নিয়ে তারা বাংলায় বিনিয়োগ করত পণ্য কেনার জন্য। একটু আগে যে কূট বাণিজ্য বুদ্ধি কথাটা ডাচেদের বাণিজ্য বিশেষণ হিসেবে বলেছি, সেটা হল তাদের গোটা এশিয় বাণিজ্য স্বনির্ভরতা, যা সব ইওরোপিয় কোম্পানির ছিল না। এশিয়ায় বাজার বুঝে হিঁয়াকা মাল হুঁয়া, আর হুঁয়াকা মাল হিঁয়া করে তার এশিয় বাণিজ্যে বিপুল উদ্বৃত্ত তৈরি হত। তারা জাপান থেকে তামা, মালয় উপদ্বীপ থেকে টিন আর দস্তা, তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে লঙ্কা, লবঙ্গ, জৈত্রী, জায়ফল ইত্যাদি বাংলায় নিয়ে আসত। শুধু বাংলা নয় দক্ষিণ ভারত আর পশ্চিম ভারতের নানান এলাকাতেও তারা ব্যবসা করত। আর বাংলার পণ্য তারা নিয়ে যেত তাদের দক্ষিণ পূর্ব এশিয় উপনিবেশ এবং পূর্ব ভারতীয় দ্বীপুঞ্জে আর ইওরোপে। হল্যান্ডে নিয়ে যেরত সুতিবস্ত্র, রেশমি বস্ত্র, কাঁচা রেশম আর সোরা।
১৮৩১/১১৩৮এ ডুপ্লে ফরাসী কোম্পানির বাংলার গভর্নর হয়ে এলেন। আলেকজান্দার হ্যামিলটনের বর্ননায় জানতে পারি চন্দননগরে ফরাসীদের সুন্দর একটা চার্চ রয়েছে। তারা সক্কলে সেই চার্চে সমবেত হয়ে প্রার্থনা করে। ডুপ্লে আসার আগে মাত্র ছ খানি দেশি নৌকোয় তাদের বাণিজ্য চলত, মাঝে মধ্যে তাদের ব্যবসাও থাকত না, তখন সেগুলি বসেও থাকত। তিনি ৩০ থেকে ৪০ টি বড় জাহাজ ব্যবস্থা করলেন বাংলায় ফরাসী ব্যবসার জন্য। চন্দননগরের ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী আর খ্বাজা ওয়াজেদ হলেন ফরাসীদের দেওয়ান, অর্থাৎ তাদের মাধ্যমে বাংলার উতপাদকেদের সঙ্গে বাণিজ্য করত ফরসীরা। তিনি যখন তার দশ বছর পরে পণ্ডিচেরির গভর্নর জেনারেল হয়ে গেলেন, তখন বাংলায় ফরাসী বানিজ্যে ৭০ খানা জাহাজ খাটছে, বাংলার পণ্য ফরাসীরা পাঠাচ্ছে সুরাট, বসরা, জেড্ডা, মোখা, এবং চীনে। তারা বাংলা থেকে সূতী আর রেশম বস্ত্র আর বাংলার সোরা কিনত আর কিনত চিনি আফিম, লাক্ষা, চাল, কড়ি ইত্যাদি।
ডুপ্লের পর বাংলায় ফরাসী ব্যবসা উদ্যম সঠিক নেতৃত্বের অভাবে ঝিমিয়ে পড়ে। আর ইওরোপে ফরাসিদের সঙ্গে ইংরেজদের নিয়মিত লড়াই তাদের বাণিজ্য মন্দার আরেকটি কারণ। তবুও ১৭৪১/১১৪৮ থেকে ১৭৫৩/১১৬০ পর্যন্ত ফরাসীদের বাণিজ্যের পরিমান নেহাতই মন্দ নয়। চুঁচুড়ার ডাচেদের ফ্যাক্টরদের চিঠি সূত্রে জানা যাচ্ছে ফরাসীদের বাংলা ব্যবসা বিপজ্জনকভাবে ঢালের দিকে যাচ্ছিল। ইওরোপে ফরাসীদের সঙ্গে ইংরেজদের সাত বছর ব্যাপী যুদ্ধ শুরু হলে ক্লাইভ ১৭৫৭/১১৬৪র মার্চ মাসে চন্দননগর দখল করে নেন।
আদতে বাংলায় পলাশীর আগে শাসকেরা অত্যন্ত দূরদর্শী ছিলেন। তারা ইওরোপিয়দের সঙ্গে ব্যবসা করতেন ঠিকই, কিন্তু ইওরোপিয়দের রাজনীতিতে মাথা গলানো, বা সামরিক ক্ষমতা বা আঞ্চলিক এলাকা দখল এবং সেই সূত্রে ক্ষমতা বৃদ্ধি বৃদ্ধি তারা সহ্য করেন নি। মোগলদের সঙ্গে ইংরেজরা বহু লড়াই হেরেছে, পলাশীর আগে বাংলায় বহুবার ইংরজরা নবাবী ফৌজের হাতে জোর মার খেয়েছে। একমাত্র আরমেনিয়দের কোন সামরিক বাহিনী ছিল না। বাংলার নবাবেরা চাইতেন অন্যান্য ইওরপিয়রা আরমেনিয়দের মত শুধুই ব্যবসা করুক, কোন রাজনৈতিক প্রভুত্বের উচ্চাশা ছাড়া। দিল্লি থেকে তারা যে সব সুযোগ সুবিধের ফরমান পতাকা বয়ে নিয়ে আসতেন সেগুলো সাধারণভাবে মান্য করেও নবাবেরা নিজেদের মত করে আইন করে তাদের ব্যবসার ওপর খবরদারি করে গিয়েছেন।
ফরাসী আর ডাচেরা দিল্লিতে দরবার করে বাণিজ্য শুল্কের হার সাড়ে তিন থেকে আরাই শতাংশে নামিয়ে নিয়েছিলেন। ১৭১৬/১১২৩শে ইংরেজরা তিন হাজার টাকার বিনিময়ে ফারুখশিয়রের ফরমান বলে বাংলায় বিনা শুল্কে ব্যবসা করার অনুমতি পেয়েছিল। ইওরোপিয় কোম্পানিগুলি দেশিয় বহির্বাণিজ্য উভয়েতেই অংশ নিত। দেশি বণিকদের কাছে কোম্পানি দস্তক অবৈধভাবে বিক্রি করা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ব্যবসা করা, শুল্ক ফাঁকি দেওয়া ইত্যাদি নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে নিয়মিত বিরোধ বাধত। সোরা আর লবনের ব্যবসায় বেশি করে বিরোধ নিয়মিত চলত। ইওরোপিয়দের জলদস্যুতা, পলাতক নবাবী কর্মচারীদের আশ্রয় দেওয়া, দেশিয় মহাজন-বণিকদের সঙ্গে বিরোধ, ইত্যাদিতে বাংলার নবাবদের সঙ্গে ইওরোপিয়দের তিক্ততা বাড়িয়ে তুলত। কর্মচারীদের উতকোচ গ্রহণ আর বাড়তি লাভের আশা এই বিরোধ আরও বাড়িয়ে তুলত।
No comments:
Post a Comment