সপ্তদশ শতকে যখন বাঙলায় মোগল রাজশক্তি পূর্ণ মাত্রায় শাসন করছে, সে সময়, বাঙলার অর্ধ সহস্রাব্দপূর্বে সমাপ্ত বৌদ্ধ রাজত্বের সামাজিক ত্রিভূজের শীর্ষে অবস্থান করা বণিকেরা সেই রাজ্যের পড়ন্ত সময়ে ফিরে এলেন বর্ণময় সনাতন সমাজের শৃঙ্খলে, পতিত হওয়ার নিদান শিরোধার্য করে(তত্ব সূত্র বেনের মেয়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী)। বাঙালি ব্যবসায়ীরা শুধু বিদেশে নয়, দেশ জুড়েও ব্যবসা করেছেন, মুকুন্দরামসহ নানা মঙ্গলকাব্য সাক্ষী। মেগল আমলে, মির জুমলা বা শায়েস্তা খাঁরমত উচ্চপদস্থ কর্মচারী অথবা আলিবর্দি খাঁর দাদা হাজি আহমদ বা সিরাজের মা আমিনা বেগম সোরা কেনাবেচার ব্যবসা করলেও, রাজদরবারের কড়া নীতি ছিল রাজপুরুষদের ব্যবসার পরিবেশ থেকে সরে থাকা। এই নীতি কঠোরভাবে মেনে চলা হত।
ঔরঙ্গজেবের ভাষায় রাজপুরুষদের ব্যবসা সওদাইখাস আর সাধারণের ব্যবসা সওদাইআম। মোঘলদের ধারণা ছিল, রাজকর্মচারীদের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া, তাদের পদমর্যাদার প্রতি শোভাবর্ধক নয়। আর সেসময় সরকারি রাজপুরুষেরা বিশেষ করে মোঘল রাজদরবারের চাকুরেরা নিয়ম মেনে সাম্রাজ্যের ব্যবসা বাণিজ্যে হস্তক্ষেপ করতেন না। সরকারি পদের অপব্যবহার করে কেউ ব্যক্তিগতভাবে বাণিজ্য করতে পারতেন না(সূত্রঃ পালাশির ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ, রজতকান্ত রায়)।
পলাশিপূর্বে, ক্রমশঃ সমুদ্র পথের বাণিজ্য বিদেশি সওদাগরদের হাতে গেলেও, সড়ক পথের বাণিজ্যে কিন্তু দেশিয় ব্যবসায়ীদের রমরমা। হুগলি বন্দরে তখন চিন, ইরান, তুরানের ব্যবসায়ীদের ভিড়। কাশিমবাজার আর মুর্শিদাবাদে গুজরাটি ব্যবসায়ীদের রেশম উপনিবেশ গড়ে উঠেছে। গুজরাট থেকে আসত তুলা আর বাঙলা থেকে জলপথে সেখানে যেত রেশমজাতদ্রব্য। কাশ্মীরের ব্যবসায়ীরা নিমকমহল থেকে নিয়ে যেত নিমক। মুর্শিদাবাদ, পাটনা, ঢাকা, হুগলির ব্যবসায়ীরা সমবেত হয়ে বাঙলার ব্যবসা বিকাশের পরিবেশ চাঙ্গা করে রেখেছিল। বাঙলা তথা ভারতের অর্থনীতি ছিল উদ্বৃত্ত।
পলাশির ঠিক আগে মুর্শিদাবাদ বয়ে হুগলি হয়ে ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু কলকাতা বন্দরে সরে আসার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছিল ক্রমশঃ ইংরেজদের নলচালনায়। বাঙলা সুবার টাকার নিয়ন্ত্রণ জগত শেঠদের হাতে ছিল বলে সেই কাজটা তখনও সমাধা হয় নি। মাদ্রাজে কোম্পানির টাঁকশাল ছিল। সেখানে কোম্পানি আর্কট টাকা ছাপাত। বাঙলায় নবাবেরা টাকা ছাপানোর দায়িত্ব ইংরেজদের হতে দেন নি। দাদু, আলিবর্দির প্রভাবে সিরাজ বুঝতেন ইংরেজদের চরিত্র। তিনি ইংরেজদের বিশ্বাস করতেন না। বাঙলার বড় টাঁকশালটা তখন মুর্শিদাবাদে, রাজমহলে ছিল আর একটা। নবাব বছর বছর তার ইজারা দিতেন। সিরাজের সঙ্গে লড়াই হওয়ার চল্লিশ বছর আগে ইংরেজরা ফারুখশিয়রের রাজদরবার থেকে প্রায় এক লক্ষ ডলার খরচ করে ব্যবসার দস্তক নেয়। সেই দস্তক জাল করে অন্যান্য বিদেশি ব্যবসায়ীদেরও অবাধে ব্যবসার সুযোগ করে তাদের কাছ থেকে ভেট নিত।
নিজের দেশ থেকে সোনারূপো আমদানি করে মহাজনদের থেকে ধারে ইংরেজরা কাপড়, রেশম, সোরা, আর অন্যান্য পণ্য ইওরোপে রপ্তানির জন্য কিনত। ১৭৫৩ পর্যন্ত গোপীনাথ শেঠ, রামকৃষ্ণ শেঠ, শোভারাম বসাক, আমিরচাঁদ বা উমিচাঁদেরমত দাদনি বণিকেরা, দাদন দিয়ে বাঙলার উত্পাদকদের থেকে ইরেজদের ব্যবসার নানান জিনিষ সরবরাহ করতেন। দাদনি বণিকদের আওতা থেকে বেরোতে এবার ইংরেজরা নিজেদের আড়ংএ বাঙালি গোমস্তা লাগিয়ে উত্পাদকদের কাছ থেকে সরাসরি পণ্যদ্রব্য কিনতে শুরু করে। ১৭৫১তে বাঙলায় কোম্পানির ইনভেস্টমেন্ট ছিল ৩৩ লক্ষ ৬৬ হাজার টাকা। ১৭৫৫তে তা কমে দাঁড়ায় ১২ লক্ষ একাশি হাজার টাকা। ফারুখশিয়রের দস্তকের আড়ালে চলল গোমস্তা আর ইংরেজদের বকলমে লাভ বেড়ে যাওয়ার খেলা।
পলাশি চক্রান্তের পর ব্রিটিশেরা ক্ষমতায় এসে ভারতীয় সমাজে কঠোরতমভাবে মেনেচলা শাসন আর ব্যবসার বিভাজন রেখা তুলে দিল। মোঘল আমলের নীতি শেকড়শুদ্ধু উপড়ে ফেলে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকার নিজেই হয়ে উঠল ব্যবসায়ী। সরকারে থাকা আমলা আর কর্মচারীরা সরকারিযন্ত্র ব্যবহার করে সারাদেশের সমাজের সামনে নামিয়ে আনল অসম্ভব বর্বরতা, নিষ্পীড়ণ আর লুঠের রাজত্ব। কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসার পাশাপাশি, উচ্চপদস্থ কোম্পানির ইঙ্গ আমলারা আর বঙ্গজ দালালেরা নিজেদের কোলে ঝোল টেনে লুঠের অর্থে নিজেরা ব্যবসা করে ধনী হয়েছেন। ভারতীয় সভ্যতায়, সমাজ, ব্যবসা আর রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার যে কঠোর বিভাজন রেখা ছিল তাও লুপ্ত হয়ে গেল।
No comments:
Post a Comment