বাংলার নবাব অভিজাত, আমীর, ধনী এবং সাধারণ মুসলমানদের বদান্যতায় ও অর্থানুকূল্যে গড়ে উঠেছিল মক্তব, মাদ্রাসা ঘিরে মুসলমান শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। মক্তব ছিল প্রাথমিক শিক্ষার জন্য পাঠশালা। শিক্ষকেরা আখুনজী নামে পরিচিত হতেন। এদের কাজ ছিল বালকদের আরবি, ফার্সি বর্ণমালা শেখানো, আরবি ফারসি সাহিত্য পড়ানো, লিখতে শেখানো, প্রাথমিক অঙ্ক শেখানো এবং ইসলামি শাস্ত্র পাঠ। মক্তবের বালকেরা কলাপাতায় তো লিখতই তার সংগে কাগজেও লিখত(হাইডন বেলেনয়ের মুঘল আমলের কাগজ-কলম ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে দারুণ একটা কাজ আছে)। খাগ আর কঞ্চির কলম আর ভুসো কালি ব্যবহার হত। মেধাবীরা উচ্চতর পাঠশালা মাদ্রাসায় যেত। মাদ্রাসাগুলি মসজিদ আর ইমামবাড়ার সংগে যুক্ত থাকত সাধারণতঃ। প্রধান শহরে যে সব মাদ্রাসা থাকত তার জন্য রাষ্ট্র অর্থ ব্যয় করত, নিষ্কর ভূমি বরাদ্দ করত। ছাত্ররা বিনামূল্যে আহার আর বাসস্থান পেত এবং পড়াশোনার জন্য অন্তত বেতন দিতে হত না। মুসলমান শাস্ত্রে পণ্ডিত, মৌলভি এবং বিদ্বানেরা এখানে পাঠ দিতেন। সফল ছাত্ররা শিক্ষকতা করত বা সরকারি বা সদওদাগরি দপ্তরে কাজ পেত। মাদ্রাসায় ছাত্রদের কোরাণ, হদিস, আইন(সরাহ), আরবি, ফারসি সাহিত্য, আরবি বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ানো হত।
সংস্কৃত শিক্ষার জন্য চতুস্পাঠী আর টোল স্থাপন করতেন জমিদারেরা। এই পাঠশালাগুলিতে আহার, বাসস্থান আর শিক্ষার ভার বহন করতেন গুরুরা, তাদের সাহায্য করতেন স্থানীয় ধনীরা। আলাদা করে শিক্ষক প্রয়োজন হত খুব কম। বাংলা জুড়ে পণ্ডিতেরা নানান জ্ঞানচর্চায় রত থাকতেন। তারা তাঁদের উত্তরসূরী তৈরি করার দায় নিতেন তোল চালিয়ে। ব্যকরণ, কাব্য, অলঙ্কার, ন্যায়, স্মৃতি, জ্যোতিষ, দর্শনের বিভিন্ন শাখা, বেদান্ত আর ছন্দ শেখানো হত। বাংলা জুড়ে প্রচুর চতুশপাঠী ছিল। রামপ্রসাদ বিদ্যাসুন্দরে একটি চতুষ্পাঠীর বর্ণনা দিয়েছেন। দ্রাবিড়, উৎকল, কাশী, মিথিলা থেকে বটুরা আসত।
চতুষ্পাঠীর পর উচ্চতর পাঠের প্রতিষ্ঠান টোল। ইংরেজরা যদিও অশ্লীলভাবে নবদ্বীপকে বাংলার অক্সফোর্ড বলেছেন, কিন্তু পশ্চিমি কেন্দ্রিভূত প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থার তুলনীয় হতে পারে না এই টোল ব্যবস্থা। নবদ্বীপ ছাড়াও বর্ধমান, বীরভূম, গুপ্তিপাড়া, ত্রিবেণী, বালী, ঢাকার রাজনগর, ভটপাড়া প্রভৃতি ছিল উচ্চতর শিক্ষার অন্যতম প্রতিভূ স্থান। ন্যয় শাস্ত্রে বাংলা ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। নবদ্বীপ এ বাবদে ভারত সেরা ছিল। রঘুনাথ শিরোমণি এই ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠাতা। ন্যয় ছাড়াও টোলগুলিতে ব্যকরণ, স্মৃতি(আইন), কাব্য, দর্শন, জ্যোতিষ, বেদ, পুরাণ এবং অভিধান। কোন একটি বিষয় নিয়ে আট থেকে ষোল বছর পড়াশোনা করত। দর্শন আর স্মৃতির পাঠ সব থেকে ভাল হত মিথিলায়(দ্বারভাঙ্গায়), ব্যকরণ আর অলঙ্কার আর বেদ পাঠের জন্য যেত কাশী।
যদিও মহিলাদের জন্য আলাদা পাঠের কোন প্রতিষ্ঠান ছিল না, কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে দীনেশচন্দ্র সেন গীতিকার উদাহরণ, কালিদাসের উদাহরণ, লহনা খুল্লনার উদাহরণ দেখিয়ে বলছেন যে এক সময় মহিলাদের পড়ানো হত, পরের দিকে তা কমে যায়। কিন্তু বাংলার প্রথাগত উৎপাদন ব্যবস্থার সংগে থাকার সূত্রে বলতে পারি, চাষ এবং শিল্পে মহিলাদের জ্ঞান আর দক্ষতার এতই প্রয়োগ হয় যে তাদের অশিক্ষিত বলা খুব কষ্টের। তাঁতিরা মসলিন তৈরি করতেন বটে অসীম দক্ষতায়, কিন্তু সেই কাপড় বুনতে চরকার সুতো কাটনিদের প্রাথমিকভাবে সেই ১৭০০ কাউন্টের সুতো কাটতে হত অসীম দক্ষতায়, তারপরে তো বোনার গল্প। তবে এডামেই বাংলায় ১৯টা পাঠশালার খবর পাচ্ছি। দীনেশ্চন্দ্র খবর দিচ্ছেন হটু, হটি বিদ্যালঙ্কারের অথবা অন্যান্য সংস্কৃতজ্ঞ মহলার যাঁরা পিতৃগৃহে বসে শাস্ত্র আর বৈদ্যক চর্চা করতেন। ভরতচন্দ্র আর রামপ্রসাদের বিদ্যাসুন্দরের নায়িকা অসাধারণ বিদুষী, জয়নারায়ণ সেনের আত্মীয়া আনন্দময়ী, দয়াময়ী আর গঙ্গামণি বিদুষী এবং কবিখ্যাতি ছিল। রাজবল্লভ বৈদ্যদের যে উপবীত যজ্ঞ করেছিলেন অথর্ববেদ ঘেঁটে যেই জটিক শাস্ত্রসম্মত যজ্ঞবেদী তৈরি করে দেন আনন্দময়ী। নাটোরের রাণী ভবানী সহ যে কজন রানী/জমিদার জমিদার সামলেছেন প্রত্যেকে জ্ঞানী ছিলেন। অভিজাত ঘরের মেয়েদের হিসেব পাই কিন্তু গাঁগঞ্জের যে মেয়েরা গাছকোমর শাড়ী পরে চাষ করছেন আর শিল্প উৎপাদন সামলাচ্ছেন এবং বাংলাকে একসময় অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে গড়ে তুলেছিলেন, তাদের বন্দনা কে করে?
মুঘল আমল থেকেই বেগম বা অভিজাত পরিবারের মহিলারা নতুন করে তাদের কর্মদক্ষতা বুদ্ধিমত্তা প্রমান করে গিয়েছেন। নতুন করে আবার বেভারিজের সব অনুবাদ ফিরে দেখা হচ্ছে এবং বেভারিজের অপঅনুবাদ ভিত্তি করে হরবংশ মুখিয়ার মত যারা মুঘল ইতিহাস লিখেছেন, তাদের ইতিহাস নতুন করে লিখছেন আজকের মহিলারা, এবং সে সময়ের মহিলাদের দক্ষতা নতুন করে লিখিত হচ্ছে। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মোগল বিদুষী ও মোগল যুগে স্ত্রী শিক্ষা অসাধারণ কোষ গ্রন্থ। ঠিক তার বাংলার বেগমদের নিয়ে বেগমস অব বেঙ্গলও সমান আকর্ষনীয়। আলিবর্দির বেগম যুদ্ধের সময় যুদ্ধক্ষেত্রে থাকতেন। মুর্শিদকুলির বেগম চরমমুহূর্তে জামাতা সুজাউদ্দিন আর দৌহিত্র সরফরাজের মধ্যে গৃহযুদ্ধ থামিয়ে দেন। সুজার কন্যা দরদানা বেগম(দ্বিতীয় মুর্শিদকুলির স্ত্রী), সরফরাজের মা জিন্নাতুন্নেসা বেগম, তার বোন নাফিসা বেগমও বিদুষী ছিলেন।
No comments:
Post a Comment