নবাব আমীর আলি খান বাহাদুরের কাহিনী
পলাশীর পর উভয় ধর্মের অভিজাতরা ব্রিটিশ দালালি করেছেন। এই লেখায় দেখবেন নবাব যেমন খেরাজ রাজস্ব ছাড়া ত্রুটিপূর্ণ অভিযোগ করে হাজার হাজার লাখেরাজ জমি ইংরেজদের হয়ে উদ্ধার করছেন, তেমনি তিনি সিপাহীদের বিরুদ্ধে কোম্পানিকেও পাটনায় বাঁচাচ্ছেন নিজের যোগাযোগ দিয়ে, অভিজাত পরিবারদের ইংরেজ পক্ষে নিয়ে এসে।
লোকনাথ ঘোষের 'কলকাতার বাবু'(দ্য নেটিভ এরিস্ট্রোক্যাসি এন্ড জেন্ট্রি অব ইন্ডিয়া বইএর বাংলা ওডিশার অভিজাতদের জীবনী কৃতির অনুবাদ) নামক বইতে বেশ কিছু নবাব, জমিদার আর রাজাদের কাজ, কুশলতা ইত্যাদি বর্ণনায় সে উল্লেখ পাই।
বইটি শুরু হয়েছে নবাব আমীর আলি খান বাহাদুরের কীর্তিকলাপ দিয়ে। লোকনাথ লিখছেন, ... এই বাঢেই পরিবারটির বাসস্থান হয়ে যায়। বাংলার নবাব নাজিম এঁদের(নবাবের পূর্বজদের) প্রচুর ধনসম্পদ দান করেন; তারপর ইংরাজগণ বিজয়ী হবার পর, পরিবারটি বহুভাবে ইংরাজ সরকারের সেবা করেন; ফলে এরা অল্পকালের মধ্যেই বিশিষ্ট ধনী হয়ে ওঠেন। মুহম্মদ রফির পুত্র ওয়ারিস আলিও প্রচুর সম্পত্তি অর্জন করেন; তাঁর পুত্র আসসুদ্দিন আহমদ ওরফে আলি আহমদ; ইনি ইংরাজ সরকারের অধীনে বহু উচ্চপদে চাকুরী করেন। লর্ড লেকের মারাঠা-বিরোধী অভিযানের সময় ইনি কয়েকটি রণক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন। ইনি উত্তরপশ্চিম প্রদেশের কয়েকটি জেলায় তহশিলদার রূপে চাকুরী করে অবসরকালীন জীবন কাটান বাঢে।
এঁরই পুত্র নবাব আমীর আলি। ...অযোধ্যার রাজা নাসিরুদ্দীন হায়দারের দূতের সহকারী হিসাবে তিনি বেন্টিঙ্কের শাসনকালে কলকাতায় চলে আসেন; এই চাকুরী করার সময় তিনি উক্ত রাজা ও ইংরাজ সরকারের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে ওঠেন। রাজার মৃত্যুর পর ১৮৩৭ সালে তিনি পুনরায় চাকুরীতে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৮৩৮এ তিনি প্রেসিডেন্সি কলকাতার স্পেশাল কমিশনারের আদালতে ডেপুটি এসিস্ট্যান্ট সুপারিন্টেন্ডেন্ট নিযুক্ত হন; ত্রুটিপূর্ণ মালিকানা বা দলিলহীন সকল লাখেরাজ সম্পত্তি ইংরাজ সরকারে বাজেয়াপ্ত করার পক্ষে ওকালতি করা ছিল তার কাজ। ...ইংরাজ সরকারের প্রতি আনুগত্য ছিল তাঁর প্রায় পুরুষানুক্রমিক বৈশিষ্ট্য এবং বংশের মধ্যে ইংরাজভক্তিতে এই নবাবই শ্রেষ্ঠ ছিলেন।
১৮৫৭য় পাটনা (সিপাহি)বিদ্রোহের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে; অন্তত ইংরাজ সরকারের ধারণা হয়েছিল তাই; সদর আদালতের অন্যতম জজ, মিঃ ই এ স্যামুয়েলসকে পাটনা বিভাগের কমিশনার করে পাঠান হল; পাটনায় তখন ধর্মান্ধ মুসলমানের সংখ্যা বিপুল। কমিশনারের ব্যক্তিগত সহকারীরূপে প্রেরিত হলেন আমীর আলি; স্থানীয় প্রধান প্রধান ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে তাঁর পরিচয় এবং তাঁর ব্যক্তিগত প্রভাব ইংরাজ সরকারকে এই মহা সঙ্কট থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করে।
...তিনি(নবাব আমীর আলি খান বাহাদুর) লিখেছেন, 'সরকার আমার জন্য একটা মাসিক বেতনেরও(মাসিক ৭০০ টাকা) ব্যবস্থা করেছিলেন; কিন্তু আমি এক পয়সাও গ্রহণ করি নি, ওকালতির স্বাধীনতাও ছেড়েছিলাম; তার কারণ, আমার মনে হয়েছিল যে, ঐ ভাবেই আমি সরকারের সর্বোত্তম সেবা করতে পারব... আর আমার যা কিছু যোগ্যতা, সে সবই এই ইংরেজ সরকারের অধীনে কাজ করেই আমি অর্জন করেছি।' অর্থ-সর্বস্ব সে-যুগে এমন নিঃস্বার্থ রাজভক্তি সত্যিই দুর্লভ। সিপাহী বিদ্রোহের সময় তাঁর রাজভক্তি ও সেবার কথা পার্লামেন্টেও আলোচিত হয়। সরকার তাঁকে সম্মানিতও করেন। নবাব কলকাতার অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট এবং জাস্টিস অফ দি পীস ছিলেন। তাঁকে ২৪ পরগণারও অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট করা হয়। বঙ্গীয় আইন পরিষদের সভ্য পদে মনোনীত করেও তাঁকে সম্মান প্রদর্শন করা হয় এবং পরবর্তী কালে তাঁকে 'আজীবন' খান বাহাদুর পদবীতে ভূষিত করা হয়। ... লর্ড নথব্রুক তাঁকে 'নবাব' উয়াপধিতে ভূষিত করেন; উপাধির সঙ্গে যথোপযুক্ত খেলাৎও দান করা হয়।
No comments:
Post a Comment