Wednesday, September 27, 2017

উভয় পক্ষের অভিজাতরাই ব্রিটিশ দালালি করেছেন

নবাব আমীর আলি খান বাহাদুরের কাহিনী

পলাশীর পর উভয় ধর্মের অভিজাতরা ব্রিটিশ দালালি করেছেন। এই লেখায় দেখবেন নবাব যেমন খেরাজ রাজস্ব ছাড়া ত্রুটিপূর্ণ অভিযোগ করে হাজার হাজার লাখেরাজ জমি ইংরেজদের হয়ে উদ্ধার করছেন, তেমনি তিনি সিপাহীদের বিরুদ্ধে কোম্পানিকেও পাটনায় বাঁচাচ্ছেন নিজের যোগাযোগ দিয়ে, অভিজাত পরিবারদের ইংরেজ পক্ষে নিয়ে এসে।

লোকনাথ ঘোষের 'কলকাতার বাবু'(দ্য নেটিভ এরিস্ট্রোক্যাসি এন্ড জেন্ট্রি অব ইন্ডিয়া বইএর বাংলা ওডিশার অভিজাতদের জীবনী কৃতির অনুবাদ) নামক বইতে বেশ কিছু নবাব, জমিদার আর রাজাদের কাজ, কুশলতা ইত্যাদি বর্ণনায় সে উল্লেখ পাই।

বইটি শুরু হয়েছে নবাব আমীর আলি খান বাহাদুরের কীর্তিকলাপ দিয়ে। লোকনাথ লিখছেন, ... এই বাঢেই পরিবারটির বাসস্থান হয়ে যায়। বাংলার নবাব নাজিম এঁদের(নবাবের পূর্বজদের) প্রচুর ধনসম্পদ দান করেন; তারপর ইংরাজগণ বিজয়ী হবার পর, পরিবারটি বহুভাবে ইংরাজ সরকারের সেবা করেন; ফলে এরা অল্পকালের মধ্যেই বিশিষ্ট ধনী হয়ে ওঠেন। মুহম্মদ রফির পুত্র ওয়ারিস আলিও প্রচুর সম্পত্তি অর্জন করেন; তাঁর পুত্র আসসুদ্দিন আহমদ ওরফে আলি আহমদ; ইনি ইংরাজ সরকারের অধীনে বহু উচ্চপদে চাকুরী করেন। লর্ড লেকের মারাঠা-বিরোধী অভিযানের সময় ইনি কয়েকটি রণক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন। ইনি উত্তরপশ্চিম প্রদেশের কয়েকটি জেলায় তহশিলদার রূপে চাকুরী করে অবসরকালীন জীবন কাটান বাঢে।

এঁরই পুত্র নবাব আমীর আলি। ...অযোধ্যার রাজা নাসিরুদ্দীন হায়দারের দূতের সহকারী হিসাবে তিনি বেন্টিঙ্কের শাসনকালে কলকাতায় চলে আসেন; এই চাকুরী করার সময় তিনি উক্ত রাজা ও ইংরাজ সরকারের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে ওঠেন। রাজার মৃত্যুর পর ১৮৩৭ সালে তিনি পুনরায় চাকুরীতে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৮৩৮এ তিনি প্রেসিডেন্সি কলকাতার স্পেশাল কমিশনারের আদালতে ডেপুটি এসিস্ট্যান্ট সুপারিন্টেন্ডেন্ট নিযুক্ত হন; ত্রুটিপূর্ণ মালিকানা বা দলিলহীন সকল লাখেরাজ সম্পত্তি ইংরাজ সরকারে বাজেয়াপ্ত করার পক্ষে ওকালতি করা ছিল তার কাজ। ...ইংরাজ সরকারের প্রতি আনুগত্য ছিল তাঁর প্রায় পুরুষানুক্রমিক বৈশিষ্ট্য এবং বংশের মধ্যে ইংরাজভক্তিতে এই নবাবই শ্রেষ্ঠ ছিলেন।

১৮৫৭য় পাটনা (সিপাহি)বিদ্রোহের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে; অন্তত ইংরাজ সরকারের ধারণা হয়েছিল তাই; সদর আদালতের অন্যতম জজ, মিঃ ই এ স্যামুয়েলসকে পাটনা বিভাগের কমিশনার করে পাঠান হল; পাটনায় তখন ধর্মান্ধ মুসলমানের সংখ্যা বিপুল। কমিশনারের ব্যক্তিগত সহকারীরূপে প্রেরিত হলেন আমীর আলি; স্থানীয় প্রধান প্রধান ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে তাঁর পরিচয় এবং তাঁর ব্যক্তিগত প্রভাব ইংরাজ সরকারকে এই মহা সঙ্কট থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করে।

...তিনি(নবাব আমীর আলি খান বাহাদুর) লিখেছেন, 'সরকার আমার জন্য একটা মাসিক বেতনেরও(মাসিক ৭০০ টাকা) ব্যবস্থা করেছিলেন; কিন্তু আমি এক পয়সাও গ্রহণ করি নি, ওকালতির স্বাধীনতাও ছেড়েছিলাম; তার কারণ, আমার মনে হয়েছিল যে, ঐ ভাবেই আমি সরকারের সর্বোত্তম সেবা করতে পারব... আর আমার যা কিছু যোগ্যতা, সে সবই এই ইংরেজ সরকারের অধীনে কাজ করেই আমি অর্জন করেছি।' অর্থ-সর্বস্ব সে-যুগে এমন নিঃস্বার্থ রাজভক্তি সত্যিই দুর্লভ। সিপাহী বিদ্রোহের সময় তাঁর রাজভক্তি ও সেবার কথা পার্লামেন্টেও আলোচিত হয়। সরকার তাঁকে সম্মানিতও করেন। নবাব কলকাতার অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট এবং জাস্টিস অফ দি পীস ছিলেন। তাঁকে ২৪ পরগণারও অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট করা হয়। বঙ্গীয় আইন পরিষদের সভ্য পদে মনোনীত করেও তাঁকে সম্মান প্রদর্শন করা হয় এবং পরবর্তী কালে তাঁকে 'আজীবন' খান বাহাদুর পদবীতে ভূষিত করা হয়। ... লর্ড নথব্রুক তাঁকে 'নবাব' উয়াপধিতে ভূষিত করেন; উপাধির সঙ্গে যথোপযুক্ত খেলাৎও দান করা হয়।

মন্তব্যগুলি

Mohammad La Gauche আমীর আলী মুঘল আমলের 'অভিজাত' ছিলেন না! তিনি 'আওয়াম' [সাধারণ মানুষ] এর স্তর থেকে ব্রিটিশ মেহেরবানী পেয়ে 'খাওয়াজ' [নোবলম্যান] এর স্তরে উঠেছিলেন! তার খেলাতগুলো সব ব্রিটিশের দেওয়া! একটাও মুঘল আমলের নেই! উনিশ শতকের কলকাতার 'ভদ্রলোক' গোষ্ঠীটি এইসব 'মুসলমান'-কে 'আদর্শ' হিসেবে মেনে নিয়েছিল! তারা ফিরিঙ্গিদের কাছে 'খাওয়াজে নও' [নয়া নোবলম্যান] বলে পরিচিত হয়েছিল! এটা শুনে-দেখে কলকাতার মিডল ক্লাস নিজেদের জন্য 'ভদ্রলোক' টাইটেলটিকে আত্ম-পরিচিতি হিসাবে বানিয়ে নিল! ওই সময় লখ্নৌ এর বাসিন্দা অতুল প্রসাদ সেন বাংলায় গজল লেখার কোশেশ করেছিলেন! কলকাতা কেন্দ্রিক 'ভদ্রলোক'রা [যারা হিন্দু] ওই ট্রাঞ্জিশনাল পেরিওডে প্রো-ব্রিটিশ মুসলমান 'খাওয়াজ' এর আদলে নিজেদের তৈরী করেছিলো! এই খাওয়াজ-রা ১৮৫৭-র গদর পরবর্তী লখ্নৌ কেন্দ্রিক ছিলেন!
পরিচালনা করুন
Biswendu Nanda এই বিশ্লেষণটি আমার কাছে নতুন।
পরিচালনা করুন
Mohammad La Gauche শর্মিলা ঠাকুরের দাদা গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর লখ্নৌ তে থাকতেন! ফরিদপুরের অতুল প্রসাদ ও লখ্নৌ তে থাকতেন! তারা সবাই ১৮৬০ এর পর ওখানে গেছেন! বেগম হাজরাত মহল নেপালে পালিয়ে যাবার পর 'আউধ' রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটে! ওই সময়ের ভয়াবহ পরিস্থিতির বর্ণনা আছে স্যার সাইয়্যেদ আহমদ খান এর অটোবায়োগ্রাফি,দাগ দেহলভী,মীর তক্বী মীর এর কবিতায় বা অন্যান্য ব্রিটিশদের লেখায়! ওই সময় ইউপি-বিহারের বহু লোক এলাকা ছেড়ে চলে যায়! আবার প্রধানত বেঙ্গল থেকে ব্রিটিশ অনুগত গোষ্ঠীগুলো ওই অঞ্চলে সেটল করে! এটা কলোনাইজেশন ট্রিক! এই সেটলাররাই তাদের নিজস্ব কালচার নির্মানের তাকিদ বোধ করে ১৮৭১ এর পর! ১৮৭১ থেকে ১৯১৫ পর্যন্ত ছিল ফুল ব্রিটিশ কনট্রোলের জমানা! ওই সময় [সম্ভবত ১৮৮২ সালে] বেঙ্গলের প্রথম অর্গানাইজড টেম্পল দক্ষিনেশ্বর মন্দিরটা তৈরী হয়,যেখানে যীশুখৃষ্টের মূর্তিও আছে! ইউপি-তে ব্রিটিশরা হিন্দভি ভাষার বিরুদ্ধে হিন্দী নাম ভাষা তৈরিতে মদদ দেয় এবং উর্দু-হিন্দী গন্ডোগোল পাকায়! বাবরী মসজিদের জায়গায় রামমন্দির ছিল,এটাও ওই মেয়াদের গল্প! বেঙ্গলে একই ট্রিক্স কাজ করেছে! তবে বিহার-ইউপিতে বাধা দেওয়ায় 'সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা' হতো! বেঙ্গলে ১৮৭১ থেকে প্রথম ১৯১৩ সালে বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত কেউ বাধা দেয়নি! তাই কলোনিয়াল সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিনা বাধায় চলেছে!
পরিচালনা করুন
Mohammad La Gauche কলকাতার সেকালের সিনেমাতে বেশ শরীফ মুসলিম খাওয়াজ-কে দেখা যায়! রবীন্দ্রনাথ সমেত নানা লিটারেচারে এদের খুব গ্লোরিফাই করে দেখানো হয়!তারা আর্ট-কালচার ছাড়া আর কিছু জানে না! তারাই সেই খাওয়াজ! কলকাতার 'ভদ্রলোক' গোষ্ঠী ছিল এদের 'মিরর ইমেজ'! 'জাতীয়তাবাদী' হিস্ট্রি পাকাতে গিয়ে এ বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়! আপনি এ বিষয়ে খুঁজলে ইন্টারেস্টিং অনেক কিছু পাবেন!
পরিচালনা করুন
Biswendu Nanda এই ইতিহাস বলছে তার পূর্বজরা নবাব ছিলেন না ঠিকই, কিন্তু তাদের অক্লেশে ধনসম্পত্তি অনুযায়ী অভিজাত বলা যায়।
পরিচালনা করুন
Mohammad La Gauche জ্বি! মুসলমান 'ফিরিঙি পসন্দ' [প্রো ব্রিটিশ] খাওয়াজ-রা বেশিরভাগ মুঘল সমাজের আপার মিডল ক্লাস অথবা ক্ষমতার দ্বন্দ্বে কোনঠাসা কোনো আমির ইত্যাদি! অবশ্য তারা সবাই ডিমরালাইজড ছিল! 'ভদ্রলোক'রা কিন্তু ছিল পরিচয়হীন মফস্বল বা গ্রামের মানুষ! ১৭৫৭-র পর রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির ধোপা হিসেবে পরে যে জায়গা কলকাতা সিটি হয়েছে সেখানে আসেন!

No comments: