ইংরেজ বণিকেরা রাতারাতি নবাব হওয়ার চেষ্টায় দেশটাকেই শ্মশানে তোলার তোড় জোড় করছিল। অবাধ মুক্ত বাণিজ্যের একটি কথার কথা। ছুতো। ইংরেজদের ভাষায় অবাধ বাণিজ্য নীতি হল, ইংরেজদের বাণিজ্যের হবে অবাধ, আর দেশি ব্যাপারীদের বাণিজ্যের রেশ থাকবে ইংরেজদের হাতে। ইংরেজরা মির কাশেমের বকলমে এই অদ্ভুত বাণিজ্য নীতি প্রয়োগ করতে গিয়ে দেখল তার শ্বশুরের তুলনায় মির কাশেম অতি কড়া ধাতের মানুষ। মির কাশেম রুখে দাঁড়ানোয় পুরোনো কিছু জমিদারির দেওয়ানরা, যেমন রাণী ভবানীর দেওয়ান দয়ারাম রায়, ইংরেজ ব্যবসায়ীদের কুঠির রেশম আটক করেন। বোয়ালিয়া কুঠির দ্রব্যও ছিল। ইংরেজদের ভয় হল দেশিয় বণিকদের ভয় দেখিয়ে আর বল প্রয়োগ করে যে অবাধ ব্যবসার জাল ছড়িয়েছে ইংরেজ বণিকেরা, সেই জাল সহজেই ছিঁড়ে যেতে পারে।
পাটনা কুঠির ব্যবসাদার আর বড় সাহেব এলিস নবাবের ফৌজএর ওপর চড়াও হলেন। যুদ্ধ শুরু হল। ইংরেজরা মির জাফরকে আবার নতুন করে মুর্শিদাবাদের মসনদে বসাল, লক্ষ্য আরও লুঠের বহর বাড়ানো। নবাব অযোধ্যায় পালিয়ে যাওয়ায় অবাধ লুঠের মাঠ উন্মুক্ত হয়ে গেল ইংরেজদের সামনে। লড়াইতে বোয়ালিয়া কুঠির আটক দ্রব্য ছাড়তে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হল ইংরেজদের। ১৭৬৬তে এই অভিজ্ঞতায় জমিদারদের নগদী সৈন্য বরখাস্ত করল ইংরেজরা। দেশের অভ্যন্তরে পাঁচশোর বেশি বাণিজ্য কুঠি বানিয়ে গোমস্তি কারবারের, যে বাঙলাজোড়া লুঠের ব্যবসা শুরু হল, তাতে দেশের সনাতন ব্যবসায়ীদের ব্যবসার মাজা ভেঙে গেল, তাঁরা প্রতিবাদ করলেও প্রতিরোধ করতে পারলেন না। টিকে গেলেন ইংরেজদের তাঁবেদার গেমস্তা, বেনিয়ান আর দেওয়ানদেরমত দালালচক্র। এরাই বাঙলার নবজাগরণের অগ্রদূতরূপে পরিগণিত হবেন।
উইলিয়ম বোল্টস বলছেন ইংরেজদের আর কোম্পানি এজেন্টদের শুধু আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যই অত্যাচারমূলক ছিলনা, রপ্তানির জন্য দ্রব্য কেনাও ছিল অভিসন্ধিমূলক। অর্থনীতিবিদ বা ঐতিহাসিকেরা যদিও বলছেন কোম্পানির ব্যবসায়ী বা উত্পাদকদের কাছ থেকে দ্রব্য কিনত, কিন্তু কেনাটা আদতে অভিনয়মাত্র, আদত পদ্ধতিটা ছিল যথাসামান্য অর্থ ব্যয় করে লুঠ, না পারলে হুমকি। চন্ডীচরণ যে, মহারাজা নন্দকুমার - শতবত্সর পূর্বের বঙ্গের সামাজিক অবস্থা পুস্তকে আরাটুনের ঘটনা বলেছেন সেটি সর্বৈব বাস্তব। এদেশিয় শহুরে বেনিয়ান গোমস্তাদের সহায়তায় আগে থেকেই কোম্পানি, বাঙলার উত্পাদকের ঘর থেকে কত পরিমান দ্রব্য, কত দামে কিনবে তা ঠিক হয়ে যেত। গোমস্তা, বেনিয়ান, দালাল আর পাইকারেরা তাঁতিদের আড়ংএ ডেকে পাঠাত। দাদন দিয়ে পণ্য সরবরাহ চুক্তি করত কোম্পানি। কোম্পানির কাছ থেকে টাকা নিতে অস্বীকার করলে তাদের বেত মারা হত। গোমস্তাদের খাতায় উত্পাদকদের নাম লেখা থাকত। কখোনো আবার এক গোমস্তা থেকে আর এক গোমস্তার অধীনেও চালান করা হত। তাঁতিরা চাহিদামত পণ্য তৈরিতে ব্যর্থ হলে তার সব পণ্য আটকে বিক্রি করে সেই টাকা উশুল করত। দেশের কারিগরদের উত্পাদনের কাঠামো ধংস করে ক্রমশঃ রেমশ ও সুতি বস্ত্র ইংলন্ডে পাঠানো বন্ধ করে সুতো পাঠানোর জন্য তুলো চাষে বাধ্য করা হত চাষীদের (সূত্রঃ সুপ্রকাশ রায়, ভারতের স্বাধীণতা সংগ্রাম ও কৃষক বিদ্রোহ )।
পলাশি উত্তরকালে সুসভ্য ব্যবসায়ী শাসক ইংরেজদের অবাধ এই বাণিজ্যের লুঠতরাজী দেখানো পথে, দ্বিতীয় সহস্রাব্দের বিশ্বায়ণের মহাভাগে সুসভ্য গণতান্ত্রিক ইওরোপিয়-আমেরিকীয় ব্যবসায়ী আর তাদের দেশিয় ব্যবসায়ী ফড়েরা বিশ্বের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন দেশিয় সম্পদ লুঠের রাজত্ব কীভাবে তৈরি করতে হয়। দেশগুলির ধণসম্পদ প্রাকৃতিক সম্পদ অভিধা দিয়ে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেখানো পথে, সরকার-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে স্থানীয় জনগোষ্ঠীগুলিকে পাশ কাটিয়ে অবাধে লুণ্ঠন করার কাজ শুরু হয়েছে। দেশের জনগোষ্ঠীগুলো হাজার হাজার বছর ধরে এই সম্পদগুলির রক্ষণাবেক্ষণ করে এসেছে। এশিয়া, আমেরিকা বা আফ্রিকার সনাতন সমাজের হাজার হাজার বছরের বিকশিত মেধা ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সম্পদ, জ্ঞান, ভাবনা অপহরণ করে, তার ওপর আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব আইন প্রয়োগ করে, তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের অবশ্য বধ্য জনগণের রায়ে গঠিত অবোধ সরকারগুলোকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে বিশ্বজোড়া আবাধ বাণিজ্য বিস্তার করে অগাধ লাভ করেছে ব্রিটেন।
বন্ধু ভাগ্যে ব্যবসা
সোরার ব্যবসা থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা আসছে অথচ এক টাকাও দাদন দিতে হচ্ছেনা। কাঠের ব্যবসায়ও একই অবস্থা। শুধু রেশমের ব্যবসায় অগ্রিম দিতে হচ্ছে। সরকারি প্রভাব খাটিয়ে এই তিন ব্যবসায় লাভ হচ্ছে বছরে আড়াই লাখ টাকা (হেস্টিংসের বন্ধু-ব্যবসায়ীদের ক্লাব বোর্ড অব ট্রেডএর প্রভাবশালী বন্ধু বারওয়েলের বাবাকে লেখা চিঠি, সূত্রঃ রজতকান্ত রায়, পালাশির ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ)।
ব্যবসার নামে লুঠ ছাড়াও সরকারের সঙ্গে লাভের চুক্তিতে ব্যক্তি ইংরেজরা রোজগার করত। বাঙালা সুবায় ব্যবসার আধিপত্য চালাবার জন্য বোর্ড অব ট্রেড তৈরি করেছিলেন হেস্টিংস। সদস্যরা নিজেদের মধ্যে গোপন চুক্তি করত, উত্পাদকদের সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানিকে পর্যন্ত ঠকিয়ে টাকা বানাতেন – ঠকচাচা হেস্টিংস সব জানতেন শুধু নয়, নিজে এই পরিকল্পনাটির জন্মদাতাও বটে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবসহ ওয়ারেন হেস্টিংসএর উপবৃত্তে ঘোরাফেরা করা বন্ধুরাই এই ধরনের পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা লাভের সুযোগ পেতেন। ১৭৬৩ থেকে দাউদাউ জ্বলতে থাকা গ্রামীণ বাঙলার বিদ্রোহ দমন করার সাথীরূপে, সক্রিয়ভাবে দেশিয় ব্যবসায়ীদের মাজা ভেঙে সম্রাজ্যের ভিত শক্ত করার প্রতিক্রিয়ায়, গ্রাম বাঙলা ছেড়ে কলকাতা শহরে চলে আসা বাঙালি গোমস্তা, বেনিয়ান, দালাল, সেরেস্তাদার আর পাইকারেরা, এই লাভের লুঠের বখরা পেয়েছেন। এঁরা আর এঁদের উত্তরসূরীরা আগামীদিনে বাঙলার নবজাগরণের উদিতসূর্য অভিধা অর্জন করবেন, সর্বজনমান্য হয়ে রইবেন আজও।
বোর্ড অব ট্রেডএ বন্ধু-ব্যবসায়ীদের(বন্ধুরা সবসময়ে ব্যবসায়ীই যে হতেন এমন নয়) সঙ্গে বাঁধ দেওয়া, রাস্তা চওড়া করা, রাস্তা তৈরি করা, কোম্পানিকে ঘোড়া, ষাঁড়, আফিম, নানান উচ্চলাভের অসামরিক-সামরিক দ্রব্য যোগান দেওয়ারমত লোভনীয় সরকারি চুক্তি হত। স্টিফেন সুলিভান, চার্লস ক্রফটস, চার্লস ব্লান্ট, জন বেলি প্রভৃতিরা এই সমস্ত উচ্চ মুনাফাদার সরকারি ব্যবসার সুযোগ পেতেন। মাটিতে দাঁড়িয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতেন কিন্তু ইংরেজ অনুগামী বাঙালি গোমস্তা, বেনিয়ান, দালাল, সেরেস্তাদার, পাইকার আর ব্যবসায়ীরা। বোর্ড অব ট্রেডএর ব্যবসার আকাশ ছোঁয়া লাভের অধিকাংশ যেত ইংরেজদের সিন্দুকে, ছিটেফোঁটাতেই খুশি থাকতে শিখেছিলেন এদেশিয় দালালেরা।
No comments:
Post a Comment