নবাবী আমলের শহুরে নবাবী আর্থব্যবস্থা বুঝতে জগৎশেঠেদের কাজকারবারে উঁকি দেওয়া জরুরি। কোন জগত শেঠ? যাদেরকে ইংরেজপন্থী বাঙালিরা বাঙলার রথসচাইল্ড নাম দিয়ে আজও কটুতম আত্মপ্রসাদ লাভ করে। জগতশেঠদের কাজকর্মই আদতে তখনকার রাজন্য বাঙলার অর্থনীতি। ফরাসিদের ধারণা ছিল জগতশেঠ ভাইরাই পলাশি চক্রান্তের মূল জন্মদাতা, তাদের ছাড়া ইংরেজরা পলাশির চক্রান্তেরমত হঠকারি-গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারত না। পলাশি উত্তর সময়ে আমীরচাঁদকে ক্লাইভ জোর করে তীর্থে যেতে নির্দেশ দিয়ে মালদায় নদিতে বিসর্জন দিলেন, আমীরচাঁদ মারা গেলেন অমৃতসরে তীর্থ করার অপূর্ণ বাসনা নিয়ে।
সিক্কার তুলনায় আর্কট(দক্ষিণ ভারতের টাকার নাম। সে এলাকায় টাকা ছাপা নিয়ন্ত্রণ করত ইংরেজরা। মাদ্রাজে সে সময় টাঁকশাল চালাচ্ছিল তারা)এর দাম বা নানান ভারতীয় মুদ্রার সঙ্গে বাঙলার টাকার দাম কত হবে তা নিয়ন্ত্রণ করতেন জগতশেঠেরা। ওলান্দাজ আর ফরাসি ব্যবসায়ীরা সকলেই জগত শেঠের গদির নিয়ন্ত্রণে ব্যবসা করত। বাঙলার বাণিজ্যে ইওরোপ থেকে আসা সব সোনা-রূপোই কিনত জগত শেঠ। টাঁকশালে টাকা বানিয়ে সুবিধামত বাজারে ছেড়ে তা দিয়ে মুদ্রার বিনিময় ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতেন শেঠ ভাইরাই। নবাবের দরবারে রেসিডেন্ট বসিয়েও জগত শেঠের সাম্রাজ্য সিরাজ হত্যার আগে ভাঙতে পারেনি ইংরেজরা। মির কাসেমকে মসনদে তুলে ইংরেজরা প্রথমেই যে পরোয়ানা জারি করে তা হল, জগতশেঠরা যেন কলকাতার সিক্কার ওপর বাটা না চায়।
জগতশেঠ পরিবারের বাতসরিক আয়ের পরিমানের একটা ধারণা হতে পারে, পলাশির চক্রান্তের পরে মুর্শিদাবাদ থেকে কর্নেল ক্লাইভকে জগতশেঠের ব্যবসার বাৎসরিক আয়এর একটা সমীক্ষা পেশ থেকে,
on the revenue at 10% Rs।10,60,000,
interest from zamindars at 12% rs।13,50,000,
on reconing rs।50lskhs at 7% rs।3,50,000,
interest on rs।40lakhs at 37।5% Rs।15,00,000,
interest on batta on exchange rs।7,00,000,
Rate Rs।7 to 8 lakhs;
toal – rs।49,60,000
সবমিলিয়ে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকার কাছাকাছি। ঐতিহাসিকেরা বলছেন, যাদের বছরের আয় আধ কোটি টাকা, তাদের মূলধন সে সময়ে পাঁচ বা ছ কোটি বা তারও অনেক বেশি টাকা হওয়া অসম্ভব নয়। গোটা বাঙলার খাজনার দুই তৃতীয়াংশ জগতশেঠের কুঠিতে জমা পড়ত আর নবাব সরকার জগতশেঠের কুঠির ওপরই বরাত(ড্রাফট) দিতেন। কোম্পানির ইংরেজরা জগতশেঠদের অর্থনীতির এই ব্যবস্থাকে নাক উঁচু করে বলত একচেটিয়া ব্যবসা। যে কোম্পানি নিজেই বাঙলায় তার দেশের হয়ে একচেটিয়া ব্যবসা চালাচ্ছে, ছুঁচ আবার চালুনির ছিদ্রের সমালোচনা করে!
সে সময় সায়ের বা শুল্ক যথেষ্ট কম থাকায়, জগতশেঠদেরমত ব্যবসায়ীদের কোষাগারে বেশি অর্থ জমত। নানান সময়ে তারা নবাবকে অর্থ সাহায্য করে, নজরানা দিয়ে নবাবের দরবার থেকে জগত শেঠ বা ফকরিতুজ্জর খেতাবও অর্জন করেছিল। ইংরেজরা ভারতীয় প্রশাসনিক ঘাঁতঘোঁত রীতিনীতি না বোঝায় যে কর্মকাণ্ড পরে বিদেশি ব্যবসায়ীদের উতকোচ বলে মনে হত – ঠিক যেমন ফাউ মানে এক্সট্রা নয় তার বেশি অনেক কিছু। ব্যবসায়ী শেঠেরা প্রায় নবাবেরমতই ঠাটেবাটে থাকতেন। কেমন ঠাটবাট? তাদের মত ব্যবসা করা খ্বাজা ওয়াজিদের সম্পদ বিষয়ে মন্তব্য করা যাক - হাতিশালে ১৫টি হাতি, ৫০টা ঘোড়া, হারেমে ১৫০ জেনানা, ১৫ চোপাদার, ২০০ চাকর – ৫টা জাহাজ আর ২০০০ নৌকো। তার তুলনায় ইংরেজ গভর্নর তো নিষ্প্রভই থাকতেন। আলিবর্দির শাসনের শেষের দিকে জগতশেঠ পরিবারের দুই ভাই, পাটনার আমীরচাঁদ আর দীপচাঁদ এবং হুগলির খ্বাজা ওয়াজিদ বাঙলার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন। সোনারূপা, হুন্ডি, টাকাপয়সার ব্যবসা করতেন তাদের মাথা ছিলেন আমির চাঁদ। পাইকারির ব্যবসার রাজা ছিলেন খ্বাজা ওয়াহিদ।
নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদ থেকে আমিল পাঠিয়ে জমিদারির খাজনা আদয় করা হত। সাধারণতঃ জগত শেঠেদের দেওয়া কর্জের মাধ্যমে ঠিক সময়ে জমিদারেরা খাজনা জমা করতেন। মুর্শিদকুলি খানের আমল থেকেই বৈশাখের প্রথম দিনে পুণ্যাহের সময় জমিদারেরা বা তার উকিলেরা মুর্শিদাবাদে পৌঁছে যেতেন। হান্টার বলছেন তারা জমায়েত হতেন জগতশেঠের কুঠিতে – নবাবি দরবারে কিন্তু নয়। সেই সভায় নবাবকে আগের বছরের আয় ব্যয়ের পাই পয়সা হিসেব নিকেশ দিতে হত। তারপর বাটার দরাদরি করে জমিদারেরা টাকা ধার করতেন শেঠদের কাছ থেকে। সেই কারবারে শেঠ পরিবার, নবাব সরকারকে জমিদারের খাজনার খাতে টাকার পাট দিতেন, ভাগ পেতেন দশ শতাংশ হারে, যার নাম পাটোয়ান। সেই খাজনা জগত শেঠের হুন্ডির মাধ্যমে বাদশাহী নজরানা রাজধানীতে পৌঁছে যেত। তখন জগত শেঠের কুঠিই বাদশাহী তোষাখানা। জমিদারি কিস্তি আর মুর্শিদাবাদে বড় আর রাজমহলে ছোট টাঁকশাল নিয়ন্ত্রণ করে জগত শেঠেরা বাঙলা সুবার অর্থনীতির ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। কর্তৃত্ব এতদূর পৌঁছেছিল যে বাঙলার অথবা নবাবের টাঁকশালের চাবি নবাবের হেফাজতে না থেকে থাকত জগতশেঠদের ট্যাঁকে।
No comments:
Post a Comment