পলাশীর অর্ধশতাব্দ পূর্বের(এবং তার কয়েক শতাব্দ পূর্বের) যে বাংলা আমরা আলোচনা করলাম তাতে বাংলাকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকেই গরীব দাগিয়ে দেওয়ার কারণ নেই। বাংলায় প্রচুর পরিমানে কৃষিজ দ্রব্য এবং শিল্প দ্রব্য রপ্তানি করত। এছাড়াও সে ছিল ভারত ও বিশ্বের নানান দ্রব্যের পরিবহনের মঝামাঝি স্থান। বিশ্ব তথা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের পণ্য দ্রব্যের এশিয়া বা ইওরোপে নিয়ে যেতে বাংলা হয়ে। এশিয়ায় বাংলার স্থানগত গুরুত্বটাকে বিচার করা হত বলে, প্রচুর অবাংলার উৎপাদন বাংলায় আসত বিভিন্ন দেশে যাওয়ার জন্য। ফলে বাংলা জুড়ে যে বিশ্ব-বাণিজ্যের সুযোগ আর বিকেন্দ্রিভূত উৎপাদন ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল, সেটি বাংলার মানুষকে মোটামুটি স্বচ্ছল করে তুলেছিল।
পলাশী পরবর্তীকাল আদতে লুঠের কাল। ইসলামের সংগে স্থানীয় পন্থগুলোর মিলমিশে যে মিলনের আবহাওয়া তৈরি হয়েছিল, সেই পরিবেশটি বজায় রাখার ইওরোপিয়দের ভাবনাতেই ছিল না। তাদের প্রথম এবং মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল বাংলা লুঠ। পলাশীর পরে পরে শুধু ক্লাইভ ঘুষ বাবদ রোজগার করেছিলেন আজকের মূল্যে ১২২৮ কোটি টাকা। তারপর ১০০ বছর কোম্পানি, তার ৯০ বছর পর ব্রিটিশ রাজ এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা কত হাজার লক্ষ কোটি টাকা লুঠ করে নিজেদের দেশের বিশাল বিশাল কারখানাগুলো তৈরি আর মানুষ লুঠ আর খুন করার প্রযুক্তি বিকাশ করতে প্রযুক্তিবিদদের(যাদের মান্য করে বিজ্ঞানী বলা হয়) অর্থসাহায্য আর ভর্তুকি দিয়েছেন বিভিন্ন সংগঠন এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সে অঙ্ক আজও কষা হয় না, নানান বাধ্যবাধকতায়। ফলে সুলতানি আমল থেকে সুবা বাংলা মুঘল আমল হয়ে যে বাণিজ্যিক আর উতপাদনিক ব্যবস্থা পরিচালনার উচ্চতায় উঠতে উঠতে নবাবী আমলের শৃঙ্গে উঠতে পেরেছিল, ঠিক সেই শৃঙ্গ থেকে নামিয়ে দেওয়ার বলপ্রয়োগের কাজ করল মির্জাফরের সংগে ক্ষমতায় যাওয়া ব্রিটিশ।
তার আর বাংলাকে সুশাসন দেওয়ার কোন দায় থাকল না। যে কোন উপায়ে বিপুল অর্থ লুঠ করে ব্রিটেনে নিয়ে গিয়ে শিল্পবিপ্লবের নানান কাজে বিনিয়োগ/ভর্তুকি দান করাই প্রথমত কর্ম হয়ে দাঁড়াল। যে মোটামুটি ধর্মনিরপেক্ষ, সুপ্রশাসন উপহার দিয়েছিল নবাবী বাংলা তাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলে বাংলাকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হল ক্ষমতাবানেদের লুঠের রাজত্বে। যে নবাবী দরবারে জমিদার নায়েব উকিলেরা ঢোকার আগে দেখে নিত কাছাকাছি তার অঞ্চলের কোন বিক্ষুদ্ধ কৃষক বা কারিগর আছেন কি না, নাহলে তাদের অত্যাচারের খবর নবাবদের কানে পৌঁছলে জমিদারদের ওপরে নেমে আসবে শাস্তির খাঁড়া, সেই বাংলার পালিত কৃষক আর কারিগরদের ছেড়ে দেওয়া হল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পোষিত বাঙ্গালি/অবাঙ্গালি লুঠেরা হায়নাদের সামনে।
রাষ্ট্রের কৃষক-কারিগরকে পালনের নীতি বদলে গিয়ে প্রশাসনের কাজ হল এক এবং অদ্বিতীয়ম লুঠের কাজে আত্মনিয়োগ করা। ইংরেজ বণিকেরা রাতারাতি নবাব হওয়ার এবং স্বদেশের শিল্পবিপ্লবের ভর্তুকি জোগাড় করার চেষ্টায় সোনার বাংলাকেই শ্মশানে তোলার তোড় জোড় করল। ফরাসি আর ডাচেদের ফণা তখন পর্যুদস্ত। ব্রিটিশদের অবাধ মুক্ত বাণিজ্যের একটি কথার কথা। ছুতো। ইংরেজদের ভাষায় অবাধ বাণিজ্য নীতি হল, ইংরেজদের বাণিজ্যের হবে অবাধ, আর দেশি ব্যাপারীদের বাণিজ্যের রেশ থাকবে ইংরেজদের হাতে।
ইংরেজরা মির কাশেমের বকলমে এই অদ্ভুত বাণিজ্য নীতি প্রয়োগ করতে গিয়ে দেখল তার শ্বশুরের তুলনায় মির কাশেম অতি কড়া ধাতের মানুষ। মির কাশেম রুখে দাঁড়ানোয় পুরোনো কিছু জমিদারির দেওয়ানরা, যেমন রাণী ভবানীর দেওয়ান দয়ারাম রায় ইংরেজ ব্যবসায়ীদের কুঠির রেশম আটক করেন। সেই আটক কাণ্ডে রাণীর এলাকার বোয়ালিয়া কুঠির দ্রব্যও ছিল। ইংরেজদের ভয় হল দেশিয় বণিকদের ভয় দেখিয়ে আর বল প্রয়োগ করে যে অবাধ লুঠ ব্যবসার জাল ছড়িয়েছে ইংরেজ শাসক বণিকেরা, সেই জাল সহজেই ছিঁড়ে যেতে পারে। পাটনা কুঠির ব্যবসাদার আর বড় সাহেব এলিস নবাবের ফৌজএর ওপর চড়াও হলেন। যুদ্ধ শুরু হল। ইংরেজরা মির জাফরকে আবার নতুন করে মুর্শিদাবাদের মসনদে বসাল, লক্ষ্য আরও লুঠের বহর বাড়ানো। নবাব অযোধ্যায় পালিয়ে যাওয়ায় অবাধ লুঠের মাঠ উন্মুক্ত হয়ে গেল ইংরেজদের সামনে। লড়াইতে বোয়ালিয়া কুঠির আটক দ্রব্য ছাড়তে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হল ইংরেজদের।
১৭৬৬/১১৭৩এ এই অভিজ্ঞতায় জমিদারদের নগদী সৈন্য বরখাস্ত করল ইংরেজরা। দেশের অভ্যন্তরে পাঁচশোর বেশি বাণিজ্য কুঠি বানিয়ে গোমস্তি কারবারের, যে বাঙলাজোড়া লুঠের ব্যবসা শুরু হল, তাতে দেশের সনাতন উৎপাদক ব্যবসায়ীদের ব্যবসার মাজা ভেঙে গেল, তাঁরা প্রতিবাদ করলেও প্রতিরোধ করতে পারলেন না। লুঠের রাজত্বে মানিয়ে নিয়ে টিকে গেলেন ইংরেজদের তাঁবেদার গেমস্তা, বেনিয়ান আর দেওয়ানদেরমত দালালচক্র। এরাই বাঙলার নবজাগরণের অগ্রদূতরূপে পরিগণিত হবেন।
পলাশীর পর বোয়ালিয়া কাণ্ড বাংলার ক্ষমতার ভারসাম্য পাল্টে যাওয়ার সময় বোঝার একটা বড় সূচক।
No comments:
Post a Comment