কয়েক দিন আগে আমরা বাংলার জমিদারি আর পলাশীর পরে লুঠ নিয়ে একটা মাঝারি গোছের লেখা করেছিলাম, মূল সুত্র ছিল কালিপ্রসন্ন ভট্টাচার্যের গবেষণা। সেই কাঠামো ধরে আমরা সুবার আর্থিক কাঠমো নিয়ে আলোচনা করব। মনে রাখা দরকার মুঘল রাজত্ব, রাজস্ব ব্যবস্থাকেই তাদের আয়ের স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে মানতেন। তারা মনে করতেন কৃষকেরা আদতে মুঘল রাজের অকৃত্রিম বন্ধু। মুঘল আমলের প্রথম থেকে, বিশেষ করে আকবরের সময় থেকে যদুনাথ সরকারের চক্ষুশূল আওরঙ্গজেবের সময়ে কৃষকদের পালন এবং তাঁর মৃত্যু এবং তার পরে সুবা বাংলায় যে নবাবী আমল প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই নবাবী আমলেও যারা ঢাকা বা মুর্শিদাবাদের তক্তে বসেছেন, তারা যেমন দিল্লির পাদশাহীকে অতীতের মত প্রাপ্য পাঠিয়েছেন, তেমনি তাদের সাম্রাজ্যের মূল স্থায়িত্বের সূত্রগুলোর একটি, কৃষক আর কারিগর পালন থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হন নি। এইটা আমাদের মনে রাখা দরকার। এখানে জমিদারি ব্যবস্থা নিয়ে যে আলোচনা করেছি, তার কিছু বিষয় আবার নতুন করে আসবে। ক্ষমাঘেন্না করে দেবেন, কিন্তু কিছু নতুন তথ্যও উপস্থাপিত হবে।
জমির দুটি চরিত্র খালসা আর জায়গির বা জাগির। খালসা হল দিল্লীতে পাঠানোর জন্য(যদিও ধরমপাল বলছেন এর একটি অংশ সুবাগুলিতে থেকে যেত – এবং প্রমান হিসেবে আওরঙ্গজেবের নাতিদের কাছে পাঠানো চিঠির বয়ান উল্লেখ করছেন, সেটা আমরা আগেও বলেছি) আর জায়গির হল প্রাদেশিক প্রশাসনের ব্যয় নির্বাহের জন্য জমির আয়। সুবাদার, নাজিম, দেওয়ান, ফৌজদার প্রভৃতি উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীরা তাদের নিজেদের ও নিজেদের কর্মচারীদের ব্যয় নির্বাহের জন্য জায়গীর পেতেন। বিভিন্ন বিভাগের – যেমন নৌবাহিনী, গোলান্দাজ বাহিনী, সীমান্তের বাহিনী, সৈন্য শিবিরের ব্যয়ের জন্য নির্দিষ্ট কছু জায়গির থাকত। জমর একটা অংশ নানান জনহিতকর কাজের জন্য নির্দিষ্ট করেছিলেন, যেগুলি নানান নামে নিষ্কর জমি ছিল।
জমিদার তিন ধরণের চরিত্রের, ১) প্রাচীন জমিদার যেমন বর্ধমান, বিষ্ণুপুর, ত্রিপুরা, কোচবিহার, সুসঙ্গ ইত্যাদি, ২) নাটোর, দীঘাপাতিয়া, ময়মনসিংহ বা মুক্তাগাছার মত নবাবী আমলে উদ্ভুত জমিদারি, ৩) বাংলার অসংখ্য মাঝারি ও ছোট জমিদার তালুকদার।
ভূমি রাজস্ব ছিল দেওয়ানের হাতে। তাই মুঘল আমলে তিনিই ছিলেন সর্বেসর্বা। তিনি আমিল, ক্রোরি, ফসলদার, ফতেদার, মোকদ্দম, শিকদার, পাটওয়ারি ইত্যাদিদের নিয়ে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতেন। কানুনগোদের কাজ ছিল ভূসম্পত্তির নথিকরণ। তিনি জমির নানান তথ্য-উপাত্ত মানে উর্বরতা, তার ন্যাহ্য কর ইত্যাদির হিসেব রাখতেন। তার নিচে ছিল খামারনবিশ এবং দেওয়ান দারোগাকে সেই তথ্য জানাতেন। ১৭০০/১১০৭ সালে মুর্শিদকুলিখাঁর দেওয়ানির সময় দিল্লীতে যেত ১১৭২৮৫৪১ টাকা, আর সিরাজের সময় দিল্লীতে নবাবদের পাঠানো শেষ রাজস্ব ১৭৫৬/১১৬৩তে গিয়েছে ১৪২৪৫৫৬১ টাকা। পঞ্চান্ন বছরে বৃদ্ধির হার খুব কম(এই প্রবন্ধে তুলনার অবকাশ নেই, কিন্তু আপনারা তুলনা করে দেখবেন, পলাশীর পর রাজস্ব তোলার হার কত বেড়েছিল)।
১৭০০/১১০৭ সালে মুর্শিদকুলি খাঁ(করতলব খাঁ তার নাম, মুর্শিদকুলি তাঁর বিশাল উপাধির একাংশমাত্র) দেওয়ানিতে বসে সম্রাটের অনুমোদন নিয়ে বাংলার জমিদারির চরিত্র কিছুটা বদলে দেন। বাংলার বড় আমলাদের কিছুটা জায়গির কেড়ে নিলেন যার পরিমান ১০২১৪১৫ টাকা। এগুলি ওডিসায় জুড়ে দেওয়া হল। জমি জরিপ করে হস্তবুদ(ভূমি আর ভূমিরাজস্বের বিস্তারিত হিসেব) গড়ে তুললেন। বাংলার জমি ভাগ হল আবাদী, অনাবাদী আর বন্ধ্যা তিন চরিত্রে। এই হস্তবুদের ভিত্তিতে গড়ে উঠল ১৭২২/১১২৯এর আসল জমা বা তুমার জমা – বাংলার নতুন ভূমি বন্দোবস্ত। নতুন ভূমি বন্দোবস্তে বাংলার রাজস্ব বাড়ালেন ১১৭২২৭৯টাকা। চৌষট্টি বছরে(১৬৫৮/১০৬৬-১৭২২/১১২৯) ভূমি রাজস্বের বৃদ্ধি ঘটল সাড়ে তের টাকা হারে।
জায়গির জমি খালসা করায় রাজস্ব বৃদ্ধি ঘটল নয় শতাংশ। খালসার রাজস্ব হল ১০৯৬০৭০৯ টাকা আর জায়গীরের জমির রাজস্ব পরিমান দল ৩৩২৭৪৭০ টাকা(জেমস গ্রান্ট, আনালিসিস অব দি ফিনানসেস অব বেঙ্গল আর ফারমিঙ্গারের ফিফথ রিপোর্ট)।
No comments:
Post a Comment