পলাশী পূর্ব সময়ে বাংলার বিশ্ব পরিচিতি অবশ্যই বয়ন শিল্পের উতকর্ষের জন্য।
বাংলার গাঁইয়া তাঁতিরা বদলে দিয়েছিল ইওরোপের কাপড় পরার ফ্যাশান। ইওরোপিয় কোম্পানিগুলো বাংলায় আসার আগে প্রভূত পরিমান সূতি বস্ত্র ইওরোপে যায় নি। ফলে ইওরোপিয় সাধারণ আর অভিজাত নাগরিকেদের গ্রীষ্মে পরতে বাধ্য হতে হত পশমের মোটা কাপড়। বাংলার সুক্ষ্ম আর মোটা সূতি আর রেশমের কাপড় ইওরোপে পৌঁছলে তা সঙ্গে সঙ্গে ইওরোপিয়দের কাপড় পরার ধরণধারণ বদলে দিল। রিজেন্সি সময়ের নানান সাহিত্য পড়লে এর ভুরি ভুরি উদাহরণ পাওয়া যাবে। লিন্ডনের আর ইওরোপের নানান জাদুঘরে বাংলার তিনিশ চাওরশ বছরের পুরোনো কাপড় আজও রাখা আছে। শোনা যায় বিভিন্ন অভিজাত জমিদার পরিবারে আজও বাংলার কাপড় পর্দা আর আসবাবের ঢাকা হিসেবে যে ব্যবহার হত তার নিদর্শন প্রদর্শিত করে রাখা আছে। ১৬১০ সালে ইওরোপে যেত ১০ লক্ষ গজ কাপড় সেটা ৬ দশক পরে হয়ে গেল ১০ কোটি গজ এবং তারপরেও ক্রমবর্ধমান। বাংলা এই উৎপাদন বৃদ্ধিটা সামলে ছিল বড় কারখানা করে নয় প্রচুর তাঁত বাড়িয়ে আর কর্মী যোগ করে। ফলে যে বিপুল লাভ আসত বাংলায় তা বেঁটে যেত গ্রামেগঞ্জের সাধারণ মানুষের মধ্যে – লাভ হয়ত কিছু বেশি রাখত বণিকেরা কিন্তু সেটা কোনভাবেই ইওরোপিয় কর্পোরেট কোম্পানির লাভের সঙ্গে তুলনীয় নয় – তবুও বাংলা কাপড় শিল্পে প্রচুর লাভ করত। বাংলার কাপড় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার নানান এলাকায় মহার্ঘ উপহার সামগ্রী হিসেবে গণ্য হত। বিভিন্ন উপাচার আর ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বাংলার কাপড় ব্যবহার ছিল আবশ্যিক বস্তু। বাংলার কাপড়ের লাভের অঙ্কদিয়ে দিয়ে ডাচেরা অতিলাভের উদ্ব্বরিত্ত আন্তঃএশিয় ব্যবসা চালাত।
বোনা হত তিন ধরণের তন্তু সূতি, রেশম আর পাট। প্রত্যেক তন্তু বয়নের সূক্ষ্ম আর মোটা উভয়ে বিভক্ত হত। বয়নের মধ্যে পড়ত রেশম ও কার্পাস বস্ত্র, চটের কাপড়, নানান ধরণের গালিচা, শতরঞ্চি, মাদুর আর শেতলপাটি। প্রত্যেকগুলোরই উৎপাদন পরিমান বিরাট, বৈচিত্র্যপূর্ণ। বাংলার অর্থনীতিতে বয়ন শিল্পের প্রভাব অন্যন্য ছিল। যদিও বাংলা-ইওরোপ বস্ত্র ব্যবসা নিয়ে বিপুল পরিমান কালি, সম্পদ আর বুদ্ধিবৃত্তি খরচ হয়েছে, কিন্তু সেই পরিমান ছিল বাংলার মোট উৎপাদনের মাত্র ১০ শতাংশ – বাংলার বিপুল উতপাদনের(৯০%) বাজার ছিল সারা ভারত, এশিয় দেশ সমূহ। ভারতের নানান প্রান্ত এবং এশিয় বাজারে ইওরোপিয় ব্যবসার বাইরে যে ব্যবসা ছিল সেটা নিয়ে খুব বেশি গবেষনার কাজ হয় নি। দক্ষিণ ভারতের তাঁতি আর তাঁত নিয়ে বিপুল কাজ করেছেন প্রসন্নন পার্থসারথি আর গুজরাটি বস্ত্র নিয়ে কাজ করেছেন রিকার্ডো মাচাডো – তার বাইরে বাংলার ব্যবসার অইওরোপ উদমের বাজারের কাজ নেই বলা যায় – ডাচেদের বাংলার বস্ত্র শিল্প বিষয়ে কাজ করেছেন ওমপ্রকাশ।
রবার্ট ওরমে বলেছেন বাংলার প্রতিটি গ্রামে পুরুষ, নারী ও শিশুরা কাপড় বোনার নানান কাজ করত। দক্ষিণ ভারতের তাঁত এবং তার উতপাদনশীলতা নিয়ে কাজ করেছেন ভারতের প্রযুক্তি আর উপনিবেশ বিরোধী ইতিহাসকর্তা ধরমপালজী। তার মতে যত পরিমান বস্ত্র রপ্তানি হত, সেই হিসেবে দক্ষিণ ভারতের তাঁতগুলিকে অন্তত দিনে ১৬ ঘন্টা চালাতে হত এবং সেই তাঁত চালানোর জন্য প্রত্যেক গৃহস্থ বাড়ির প্রত্যেক নারী ও শিশুকে ঐ একই সময় ধরে সুতো কাটতে হত। ফলে গ্রামে বিপুল পরিমান অর্থ যেত পারিশ্রমিক হিসেবে। পর্যটকেরা বলছেন, শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে পা বাড়ালে দেখা যেত পুরুষ, নারী এবং শিশু সুতোকাটায় ব্যস্ত। অনেকেই বলেছেন বাংলার তাঁতির আর্থিক স্বাছন্দ্য ততটা ছিল না। দক্ষিণ ভারতের তাঁতির সঙ্গে ইওরোপের তাঁতির রোজগারের তুলনা করেছেন প্রসন্নন পার্থসারথি, তার মতে দক্ষিণ ভারতের তাঁতিদের রোজগার অনেক বেশি। ফলে সেই হিসেবে বলা যায় বাংলার তাঁতিদের রোজগার খুব কম ছিল না। ওরমে বলছেন মহাজন দালাল ও রাজকর্মচারীরা এদের নিগৃহীত করত। তবে রাজকর্মচারীদের অত্যাচার বিষয়ে বলা যায়, যে মুঘল এবং নবাবী আমল পর্যন্ত চাষী আর কারিগরেরা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পেয়ে এসেছে। ছুটকোছাটকা অত্যাচার ছাড়া এদের ওপর কোন রকম অত্যাচার করা যেত না। এটা আমরা যদুনাথ সরকারের মুঘল এডমিনিস্ট্রেশনে পাচ্ছি। কারিগরদের ওপর কোন অত্যাচারের খবরে সরাসরি প্রাণদণ্ডের আদেশ ছিল।
(ক্রমশঃ)
(ক্রমশঃ)
No comments:
Post a Comment