আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে দু ধরণের লবণ বিক্রি হত, একটি মাদ্রাজের করকচ আরেকটি বাংলা-ওডিসার সুন্দর সাদা লবণ। বাংলার লবনের চাহিদা ব্যপক ছিল। লবণ উত্তরভারতে পাঠানো হত কাশী আর মির্জাপুরে – সেখান থেকে অযোধ্যা, এলাহাবাদ, বুন্দেলখণ্ড আর মালব। অসম আর উত্তরপূর্বে বাংলার লবণ যেত বিপুল পরিমানে। ৫-৬শ টনের ভারবাহী চল্লিশটি নৌকো অসমে লবণ নিয়ে যেত প্রতিবছর। শুধু লনব বাণজ্যে বাংলার লাভ হত প্রায় ২০০ শতাংশ।
বাংলা যদিও বিখ্যাত ছিল বস্ত্রের জন্য কিন্তু যা উৎপাদন হত, তার কাছাকাছি কার্পাস উৎপাদন হত না বাংলায়। আর যত পরিমান রেশম উৎপাদন হত বাংলায় ঠিক ততপরিমান রেশমি বস্ত্র তৈরি হত না এখানে। ফলে তুলো-রেশমের কাঁচামাল আদান-প্রদানের বাণিজ্য গড়ে উঠেছিল বাংলা-গুজরাটে। গুজরাট রাজ্য থেকে বিপুল পরিমান তুলো দিত বাংলাকে যার দাম তুলনামূলকভাবে কম আর বাংলা কাঁচা রেশম দিত গুজরাটে, যার দাম তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। আলিবর্দীর সময় শুধু চুণাখালি(মুর্শিদাবাদ) শুল্কচৌকির যে হিসেব পাওয়া যায় তাতে বাংলার বার্ষিক ৭০ লক্ষ টাকার রেশম আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে ব্যবহার হত – এই হিসেবে ইওরোপিয়দের রেশম কেনার হিসেব ধরা হয় নি। ফলে বাংলা-গুজরাটের মধ্যে যে বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি হত তা গুজরাট পোষাত বাংলা থেকে বিপুল পরিমান খাদ্যদ্রব্য কিনে, এবং এই বিপুল পরিমান খাদ্য ফ্রব্য বাংলা থেকে গুজরাটে দক্ষিণাপথ বেয়ে নিয়ে যেত যাযাবর জিপসিরা অতি ন্যুনতম ব্যয়ে।
যেহেতু বাংলার একটি বড় উৎপাদন ছিল আখ, এবং পুণ্ড্রবর্ধনের একটি আখের প্রজাতির নাম পুণ্ডু, এবং তার ব্যপ্তি ছিল সারা ভারত জুড়ে, তাই বাংলার একটি বড় উৎপাদন ছিল চিনি এবং তার সুনাম ছড়িয়েছিল বাংলা, ভারত ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়েও। ১৭৫৬র হিসেবে বাংলার বাণিজ্য পণ্যের একটা বড় রপ্তানি হল চিনি – যেত মাদ্রাজ, মালাবার, বোম্বাই, সুরাট আর সিন্ধু এবং দক্ষিণ পূর্বের দেশগুলিতে। এই সময়ে বাংলার মোট বার্ষিক রপ্তানিযোগ্য চিনির পরিমান ছিল ৫০ হাজার মন। চিনির ব্যবসায় প্রায় ৫০ শতাংশ লাভ হত।
বাংলায় চটের বিপুল ব্যবহার ছিল। উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজের মেয়েরা হাতে চটের নানান রকম পণ্য বুনত। যার নাম ধোকড়া। এই ধোকড়া বা চটের শতরঞ্চির ব্যাপক ব্যবসা করত বাংলা। তবে ইওরোপিয়রা পলাশীর আগে চটের ব্যবসায় ঠিক মত ঢোকে নি। কোম্পানির বম্বে আর মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি বাংলাকে কিছুটা চটের গানি থলের বরাত দিয়েছিল।
বেশ কিছু কৃষিজ পণ্য লঙ্কা, চাল, আফিম, আদা, হলুদ ভারতের বিভিন্ন উপকূলে রপ্তানি হত। বাংলা সে সব অঞ্চল থেকে আমদানি করত শঙ্খ, টিন, কড়ি, ফল, ভেষজ, ওষুধ ইত্যাদি। ফরাসি, ইংরেজ, ওলান্দাজেরা আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করত। এরা বাংলা থেকে চিনি চাল থলে আদা হলুদ তেল ইত্যাদি বম্বাই মাদ্রাজ সুরাট পুদুচ্চেরি কালিকট মাহে প্রভৃতি এলাকায় বিক্রি করত। এছাড়াও ফ্রি মার্চেন্ট এবং কোম্পানির প্রাক্তন কর্মচারীরাও এই ব্যবসায় অংশ নিত।
একইরকমভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যও বিপুল পরিমান বাংলার পক্ষে ছিল। ইংরেজ, ফরাসি, ওলান্দাজ, দিনেমার, বেলজিয়াম আর জার্মানদের সঙ্গে বাংলার বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। এছাড়াও পূর্ব ও পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাংলার ভাল বাণিজ্য সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। পশ্চিমে আরব, পারস্য, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, ইরাক, সিরিয়া, মিশর এবং কায়রোর মধ্যে দিয়ে অটোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে বিপুল বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বাংলার। ডাও বলছেন পূর্ব এশিয়ার বাটাভিয়া, সুমাত্রা, মালয়, বার্মা, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ইন্দোচিন, পেগু, আরাকান আর চিনের সঙ্গে ব্যাপক বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল বাংলা-ওডিশার নানান বন্দর মার্ফৎ। কার্তিক মাস লক্ষ্মী পূর্ণিমার দিন বাংলা ওডিসার মেয়েরা কলা গাছের খোলা পালতোলা জাহাজের মত করে সাজিয়ে যে কোন জলাশয়ে ভাসিয়ে দেন। এটি আদতে বাঙ্গালি-ওডিয়া নাবিকদের দক্ষিণ-পূর্ব দেশে যাওয়ার স্মৃতি। পি জে মার্সাল ইস্ট ইন্ডিয়ান ফর্চুনসএ লিখছেন, ওলান্দাজদের মোট এশিয় বাণিজ্যের এক তৃতীয়াংশ বাংলার সঙ্গে আর ইংরেজদের মোড় এশিয় বাণিজ্যের ষাট শতাংশ বাংলার সঙ্গে সম্পাদিত হত। ডাও বলছেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাংলার পক্ষে ছিল এবং এই বাণিজ্যে বাংলা বিপুল অর্থ উপার্জন করত। আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যে বাংলার লাভের পরিমান দাঁড়াত এ কোটি ষোল লক্ষ টাকারও বেশি।
আলেকজান্ডার হ্যামিলটন হুগলিকে বাংলার সব থেকে বড় আমদানি রপ্তানি বন্দর বলে উল্লেখ করেছিলেন। এ সময় হুগলি ছিল বক্স বন্দর বা বক্সী বন্দর, বাংলা সুবায় সব থেকে বড় শুল্ক চৌকি – যেহেতু বক্সীরা বন্দরের শুল্ক আদায়ের প্রধান ছিলেন তাই যে কোন বন্দরই বক্সী বন্দর নামে পরিচিত। ১৭২৮/১১৩৫ সালে হুগলি বন্দরে আমদানি-রপ্তানি শুল্কে আদায় হয়েছিল দুলক্ষ বিয়াল্লিশ হাজার চৌদ্দ সিক্কা টাকা। এর সঙ্গে যদিও পাশাপাশি নটি গঞ্জের শুল্কও ধরা আছে।
পলাশীর সময় হুগলিকে ম্লান করে কলকাতার উত্থান। ফরাসী আর ডাচেদের বাংলা থেকে ক্রম বিলয়, বাংলায় ইংরেজদের ব্যবসা বাণিজ্য আর রাজনৈতিক, প্রশাসনিক পকড় বাড়াতে সাহায্য করে। এখানে গড়ে ৫০টা জাহাজ আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলার রপ্তানি ও আমদানি পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত হত। এক লক্ষ নিবাসী কলকাতার তখন বাণিজ্যের পরিমান ১ কোটি টাকা। গ্রোস বলছেন বাংলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে তখন ৫০/৬০টা বড় জাহাজ প্রয়োজন হত।
(ক্রমশঃ)
No comments:
Post a Comment