এই পর্ব শুরু করতে গিয়ে বলা গিয়েছিল যে বাংলা তথা ভারতের উৎপাদন ব্যবস্থার ধরণ ইওরোপিয় চাপিয়ে দেওয়া কেন্দ্রিভূত উৎপাদন ব্যবস্থার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কর্পোরেটরা তাদের মত ব্যসা করত, আর বাংলা তাদের মত করে উৎপাদন। ইওরোপিয়রা সারা বিশ্ব লুটে বিপুল সোনাদানা নিয়ে বাংলায় পণ্য কিনতে আসত, তার নাম ছিল ইনভেস্টমেন্ট। প্রত্যেক কর্পোরেট একই ধরণের ব্যবসা পদ্ধতি অনুসরণ করত। তারা উতপাদকেদের অগ্রিম দাদন দিত, যাতে উৎপাদকেরা নির্দিষ্ট পরিমান পণ্য তাদের দিতে বাধ্য থাকে।
কোম্পানি কিন্তু দাদনি বণিকদের সঙ্গে প্রাথমিকভাবে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে না, তারা চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে উৎপাদকের সঙ্গে, মাঝখানে থাকছে দালাল, সেই দালালই কোম্পানির হয়ে উতপাদকেদের অগ্রম দিত। যে দালাল ব্যবসায়ীরা দাদন দিত তাদের নাম ছিল দাদনি বণিক। এদের একটা বড় অংশ নবজাগরণের অগ্রদূতেদের পূর্বজ। এরা নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট দামে নির্দিষ্ট গুণমানে নির্দিষ্ট পণ্য নির্দিষ্ট কুঠিতে সরবরাহ করতে বাধ্য থাকত। এরা পণ্যের অর্ধেক অগ্রম পেত, যা উতপাদকেদের দিতে হত, আর মোট ব্যবসার একটা অংশ দালালি পেত। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার বহু ঐতিহাসিক স্বীকারই করেন নি, কিন্তু হাতে গোণা ঐতিহাসিক – যেমন দাক্ষিণাত্যে্র তাঁতিদের নিয়ে কাজ করা প্রসন্নন পার্থসারথি বা বাংলায় ডাচেদের নিয়ে কাজ করা ওমপ্রকাশ দাবি করেছেন তাঁতিরা(এবং হয়ত অন্যান্য উৎপাদকেরাও দাদন ফিরিয়ে দিতে পারত, এবং পলাশীর পরে রাষ্ট্রীয় অত্যাচারে তাদের এই হাজার হাজার বছরের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। বলা দরকার পলাশীর আগে নবাবেরা বা তার আগের মুঘল আমলে উতপাদকেদের অস্বাভাবিকভাবে লালন পালন করা হত। তাদের ওপর যে কোন অত্যাচার কঠোর হাতে দমন করা হত। তাই হয়ত উৎপাদকেরা অনেক বেশি জোর পেতেন যে কোন অত্যাচার রুখবার। ফলে দাদন বাতিলের মত অসাধারণ অধিকারের জন্ম হয়েছিল বাংলা তথা ভারতের মাটিতে। অধিকার রক্ষার আন্দোলনে কোন দিনই এই বিষয় আলোচনা হয় নি, যতটা আলোচনা হয়েছে এই সময়ের কথিত সামন্ততন্ত্রের ভুত নিয়ে) দাদন বাতিল করতে পারতেন। ছোটলোকেদের দাদন কারণ না দেখিয়ে ফেরৎ অধিকার বজায় থাকলে কর্পোরেট ব্যবসা জমে না। তাই বারবার কোম্পানিগুলোর খাতায় অভিযোগ করা হয়েছিল যে তারা নির্দিষ্ট সময়ে মাল্পত্র পাচ্ছে না। তাই ইওরোপিয় ব্যবসায় একচ্ছত্র ইংরেজ কোম্পানি নতুন এজেন্সি ব্যবস্থা নিয়ে এল বাংলায় ১৭৬৫/১১৬০ সালে, পলাশী হতে তখনও বছর চারেক বাকি। এবারে কোম্পানি প্রাথমিকভাবে চুক্তিবদ্ধ হল নতুন ধরণের দালালদের সঙ্গে, যাদের নাম গোমস্তা। এই দালালেরা কোন উতপাদকেদের কি দেবে সেটা তাদের মাথা ব্যথা, কোম্পানির ঘরে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পরিমান পণ্য এলেই হল। এবারে আর দাদনি বণিকদের আর অস্তিত্ব থাকল না।
এই সময় পর্যন্ত কর্পোরেট কোম্পানিগুলি সারা বিশ্ব লুঠ করে বাংলায় আসছিল পণ্য কেনার জন্য। এশিয় বিশ্বের বাইরে এমন কিছু উৎপন্ন হয় না যা বাংলা তথা এশিয়ার বাজারে চলতে পারে। ফলে ইওরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা আর এশিয়ার অন্যান্য দেশ উজাড় করে সোনা রূপো জাহাজে ভর্তি করে বাংলায় নিয়ে আসত। পলাশীর আগে ইওরোপের আমদানির ৭৪ শতাংশ ছিল সোনা আর রূপো। আর ছিল ব্রড ক্লথ, পশমের কাপড়, দস্তা, সীসে, লোহা, টিন, তামা, পারদ, অস্ত্রশস্ত্র, মদ্য ইত্যাদি যা মোট বাণিজ্য পরিমানে নগণ্য থেকে নগণ্যতর। ডাচেরা যে তামা আনত, তা তাদের ব্যবসার তুলনায় এতই কম যে, সেগুলি তাদের পণ্য নিয়ে আসার জাবদা খাতায় লেখাই হত না, তার ইতিহাস পাওয়া গিয়েছে বাংলার শুল্ক চৌকিতে কোম্পানির শুল্ক দেওয়ার হিসেবের খাতায়। বেচু ইংরেজরা জাহাজ ভর্তি করে প্রচুর ব্রড ক্লথ নিয়ে আসত বাংলায় কিন্তু একটাও বিক্রি হত না(লেটার টু দ্য কোর্ট দ্রষ্টব্য), পড়ে থাকত কুঠির গুদামে – হয়ত কোন ইংরেজ পালিত দাদনিবণিক গর্ব সহকারে নিয়ে যেত বাড়িতে, যদিও তারা হাতে গোনাও নয়, করগোণা (রীলা মুখার্জীর কাশিমবাজারের রেশম শিল্পের গবেষণা – সেন্টারের ওকেশনাল পেপার, The_story_of_kassimbazar_stil_merchants_and_commerce_in_the_eighteenth_century)। এদেরই উত্তরপুরুষেরাই হয়ত ব্রিটিশের পা-চাঁটা নবজাগরণের অগ্রদূত হয়েছেন। রপ্তানি বাণিজ্যের লাভ আমদানি বাণিজ্যের ক্ষতিকে পুষিয়ে দিত। ইওরোপে ভারতীয় বস্ত্রের ওপর উচ্চহারে আমদানি শুল্ক ধার্য করা হয়েছিল। তবে ইওরোপের বাজারে বাংলার সুতি আর রেশম বস্ত্রের এত চাহিদা ছিল যে তার প্রভাব কিছুই ছিল না। ইংরেজরা বাংলায় এই সময়ে যে বাণিজ্য করত, তার বার্ষিক পরিমান দাঁড়াত তিন লক্ষ পাউন্ড বা চব্বিশ লক্ষ টাকা। ১৭০৮/১১১৫ থেকে ১৭৫৬/১১৬৩ পর্যন্ত বাংলায় ইংরেজরা ৬৪০৬০২৩ পাউন্ড দামের সোনারূপো আর ২২,৮৩,৮৪৩ পাউন্ডের পণ্য এনেছিল। ১৭০০/১১০৭এ রপ্তানি আবণিজ্যের পরিমান ছিল ১৮,৯৬,৯৬৮ টাকা বা ২৩৭১২১ পাউন্ড। ১৭৫৫য় রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমান গিয়ে দাঁড়াল ৩২৯২০৪০ টাকা বা ৩৩০৯৩৮ টাকা। প্রাক পলাশী যুগে ১৭৪২/১১৪৯ সালে সব থেকে বেশি বাণিজ্য করেছিল ৪৪৮৩১৬০ টাকা বা ৫৬০৩৯৫ পাউন্ড। এই সময়ে অংশীদারেরা ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে লভ্যাংশ পেতেন।
(ক্রমশঃ)
No comments:
Post a Comment