গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র তাদের শাখা প্রশাখা নিয়ে সারা বাংলায় বিশেষ করে পূর্ববঙ্গে আর উত্তরবঙ্গে নদী পরিবহনের আর যোগাযোগের বিপুল ছড়ানো ব্যবস্থা করেছিল ঐতিহাসিককাল থেকেই। ডাও লিখছেন, এখানে প্রতিটি গ্রামের জন্য একটি খাল, প্রত্যেক পরগণায় অন=বশ্যই একটি নদী, সমস্ত দেশের জন্য গঙ্গা বিভিন্ন ধারায় সাগরে পড়ে শিল্প পণ্যের দুয়ার উন্মুক্ত করে রেখেছে। রেনেল তার মেমোয়ার ম্যাপ অব হিন্দোস্তানে লিখছেন, বাংলা দেশে সাধারণত কোন স্থান থেকে পঁচিশ মাইল দূরত্বের মধ্যে নদী পরিবহনের ব্যবস্থা ছিল। বাংলাদেশে সাধারণত আট মাইলের মধ্যে নদী পাওয়া যায়। এই পরিবহন ব্যবস্থায় কর্মরত থাকতেন অন্তত ত্রিশ হাজার মানুষ।
বাংলার জলপথে সে সময়ের এক কোটি মানুষের অপরিহার্য খাদ্য ও লবণ পরিবাহিত হত। বছরে দুই মিলিয়ন পাউণ্ডের অর্থাৎ এক কোটি ষাট লক্ষ টাকার আমদানি-রপ্তানি পণ্য নদিপথে পরিবহন করা হত। বাংলার আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য শিল্প পণ্য, কৃষি কর্মে উৎপন্ন ফসল, বাংলার মাছ আর অন্যান্য পণ্য নদীপথেই বিভিন্ন জেলা আর গ্রামে যেত। ১৭৫৫/১১৬২ সালে ডিরেক্টর সভাকে লিখিত চিঠিতে কলকাতা কাউন্সিল জানাচ্ছে যে, মালদা থেকে কলকাতায় কাপড়ের গাঁটরি আনতে পঁয়তাল্লিস থেকে পঞ্চাশ দিন সময় লাগত।
কলকাতা থেকে দুটি জলপথ জলঙ্গী নদী হয়ে নদীয়া হয়ে কোশী নদীর দিকে, অন্যটী ভাগীরথী হয়ে সুতী পেরিয়ে বিহারের মুঙ্গের ও পাটনা পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। বিহারের বিপুল পরিমান সোরা এই পথেই চুঁচুড়া, চন্দননগর হয়ে কলকাতায় আসত। কলকাতা থেকে জলপথে ঢাকা যেতে হলে জলঙ্গী হয়ে পদ্মা, সেখান থেকে পাবনা হয়ে ইছামতীর ধরে জাফরগঞ্জ, সেখান থেকে ধলেশ্বরী হয়ে ঢাকা। ঢাকা থেকে গোয়ালপাড়া যাওয়ার নদী পথে পড়ত লখিয়া নদী আর পুরাতন ব্রহ্মপুত্র। ঢাকা থেকে নদীপথে শ্রীহট্ট যেতে হলে বুড়িগঙ্গা, ছোট মেঘনা ও সুরমা নদী পাড়ি দিতে হত। পূব বাংলার নদী-জালের জন্য এক স্থ্যান থেকে কোন দূর স্থানে যেতে নদী পরিবহনে কোন সমস্যা হত না। পূর্ববঙ্গের প্রতিটি প্রধান শহর ও শিল্প কেন্দ্রের সঙ্গে নদীপথে যোগাযোগ ছিল। বিদেশি পর্যটক পূব বাংলার নদীপথ আর নৌপরিবহনের উচ্ছিসিত প্রশংসা করেছেন। স্ট্যাভেরিনাস ভয়েজে লিখছেন অসংখ্য শহর ও গঞ্জ, নয়ন মনোহর ধান ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে নদীগুলো প্রবাহিত। নদীগুলো দেখতে অতীব সুন্দর ও অত্যন্ত উপযোগী। কোন কোন নদী এত বড় গভীর আর চওড়া যে এগুলি দয়ে স্বচ্ছন্দে বড় জাহাজ যেতে পারে।
রেনেল তার মেমোয়ারে বলছেন সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে অসংখ্য নাব্য নদী পরিবাহিত হত। এগুলি দিয়ে পরিবহনের কাজ চলত। এখান থেকে জলঙ্গী পর্যন্ত নাব্য নদীপথ ছিল। সহজে নদীপথে ঢাকা যাওয়া যেত। নবাবগঞ্জ খাল দিয়ে হাজিগঞ্জ থেকে সহজেই ঢাকা ও লখিপুর যাওয়ার জলপথ ছিল। কর্ণফুলি থেকে রাঙ্গামাটি পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশ মাইল দীর্ঘ নদীপথ আভ্যন্তরীণ নৌপথ হিসেবে ব্যবহার হত। বরিশালের বিপরীতে দুর্গাপুর খাল দিয়ে লখিপুর হয়ে বাখরগঞ্জ যাওয়ার জলপথ ছিল, বুড়িগঙ্গায় সারা বছর, গরমের দিনেও বড় বড় নৌক চলত। মেঘনার শাখা পঙ্খিয়া দিয়ে সারা বছর মাল বোঝাই নৌকো যাতায়াত করত। ছোট মেঘনা দিয়ে শ্রীহট্ট যাওয়া যেত। গঙ্গা-পদ্মা পথ ছাড়াও জলঙ্গী থেকে আত্রায়ী নদী দিয়ে ঢাকা যাওয়া যেত এ কথা আগেই বলেছি।
উত্তরবঙ্গের পুনর্ভবা, ধরলা, আর তিস্তা, মানস, ঘাগট খাল নৌপরিবহনে সাহায্য করত বলছেন রেনেল তার জার্নালে। ঘাগট খালে জানুয়ারি মাসেই দেড়শ মণ নৌকো স্বচ্ছন্দে চলাচল করত। ধরলায় সারা বছরই দুহাজার মণী নৌকো চলত। এই পথটি রঙ্গপুরের কুড়িগ্রাম থেকে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত প্রসারিত ছিল।
No comments:
Post a Comment