বাঙ্গালার ইতিহাস- প্রথম খণ্ড
(মাস কয়েক আগে মাছ খাওয়া বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি হতে পারে এই আশঙ্কা লিখতে গিয়ে পাল আমলে কৈবর্তদের লড়াই নিয়ে কিছু সংগৃহীত তথ্য দিয়েছিলাম। এবারে খোদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়এর বাঙ্গালার ইতিহাস- প্রথম খণ্ড থেকে কৈবর্ত বিদ্রোহের অংশটা তুলে দেওয়া গেল।)
তৃতীয় বিগ্রহপালদেবের জীবিতকালে অথবা তাঁহার মৃত্যুর অব্যবহিত পরে উত্তরবঙ্গে কৈবর্ত্তগণ বিদ্রোহী হইয়াছিলেন। সন্ধ্যাকরনন্দী-বিরচিত ‘রামচরিত’ কাব্যে কৈবর্ত্ত-বিদ্রোহ এবং বিদ্রোহ দমনার্থ রামপালের যুদ্ধাভিযান বর্ণিত হইয়াছে। তৃতীয় বিগ্রহপালিদেবের মৃত্যুর পরে তাঁহার জৈষ্ঠ পুত্র দ্বিতীয় মহীপাল পাল সাম্রাজ্যের অবশিষ্টাংশের অধিকার প্রাপ্ত হইয়াছিলেন (তম্নন্দনশ্চন্দন-বারি-হারি/কীর্ত্তিপ্রভানন্দিত-বিশ্বগীতঃ।/ শ্রীমান মহীপাল ইতি দ্বিতীয়ো/ দ্বিজেশ্মৌলী শিববদ্বভুব।১৩(গৌড়লেখলামা, পৃ ১৫১)। মহীপাল রাজ্যাধিকার পাইয়া মন্ত্রিগণের পরামর্শের বিরুদ্ধে অনীতিক আচরণ আরম্ভ করিয়াছিলেন এবং রামপালকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলেন(প্রথমমিত্যাদি। প্রথমং পিতরি বিগ্রহপাল উপরতে সাত মহীপালে ভ্রাতরি ক্ষমাভারং ভূভারং বিভ্রতি সতি অনাতিকারম্ভরতে অনাতিকে নীতিবিরুদ্ধে আরম্ভে উদ্যমে রতে সতি মহীপালঃ ষাডগুণ্যশল্যস্য মন্ত্রিনো গুণিতমবগুণয়ন উপষ্টম্ভার ভটীমাত্রাদীযৎগ্রহণেন...। – রামচরিত, ১।৪৩ টীকা)। রামপালের দ্বিতীয় ভ্রাতা শূরপালও রামপালের সহিত কারাগারে আবদ্ধ হইয়াছিলেন(অন্যত্র। অপরেণ ভ্রাত্রা সুরপালেন সহ কষ্টাগারং মহদমবনং রক্ষণং যত্র দুর্দ্দৈবাধীনে নবা নূতনায়সী লোহসম্বন্ধিনী কুশী নিগড়রূপা সা লতেব জঙ্ঘাতরু বিদূরবেষ্টনাৎ তয়া ভেদিনী বিদীর্ণে অকুচে অংসকোটনী জানুনী অষ্টীবতী যস্য। রামচরিত ঐ টীকা)। মহীপাল ভ্রাতৃদ্বয় কর্ত্তৃক সিংহাসনচ্যুত হইবার ভয়ে তাহাদিগকে কারারুদ্ধ করিয়াছিলেন(অন্যত্র। বিজনে স্থানমবস্থানং তেন ব্যহো বিগত উহো যস্য তস্মিন যস্য মায়া লক্ষ্ম্যী মৃগতৃষ্ণয়া মমায়ং গ্রহীশ্যতীতি মুগ্ধতয়া অন্তরীতে তিরোহিতে ভূনীগৃহাদিগুপ্তক্ষিপ্তে রামপালে সতি। - রামচরিত, ১.৩৬ টীকা।)। খলস্বভাব ব্যক্তিগণ মহীপালকে কহিয়াছিলেন যে রামপাল কৃতী এবং ক্ষমতাশালী, সুতরাং বলপূর্ব্বক তাঁহার রাজ্য গ্রহণ করিবেন অথবা তাঁহাকে হত্যা করিবেন(অন্যত্র। মায়িনাং খলানাং ধ্বনিনা অয়ং ক্ষমোহধিকারী সর্ব্ব সম্মত দেবস্য রাজ্যং গ্রহীষ্যতীতি সূচনয়া শঙ্কিতবিপদঃ মামসৌ হনিষ্যতীতি শঙ্কিতাবিপদ্যেন তস্য ভূবোর্তুর্তূর্ম্মহীপালস্য প্রভূতীয়া বহুতরায়া নিরাকৃতিপ্রযুক্তিতঃ শাঠ্যপ্রয়োগাৎ উপায়বধচেষ্টয়া তথা ত্বনাকারেনাপন্নে দুর্গতে কনিষ্ঠে ভ্রাতরি রামপালে রক্ষিতরি ভাব্যার্থে। - রামচরিত, ১.৩৯ টীকা)। এই জন্য মহীপাল রামপালকে শাঠ্যপ্রয়োগে বধ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন এবং অবশেষে তাঁহাকে কারারুদ্ধ করিয়াছিলেন। রামপালদেব যে সময়ে কারারুদ্ধ সেই সময়ে মহীপাল সামান্য সেনা লইয়া বিদ্যোহীগণের সম্মিলিত সেনাসমূহের সহিত যুদ্ধে পরাজিত হইয়া নিহত হইয়াছিলেন (...মিলিতানন্তসাম্নতচক্রচতুরচতুরঙ্গবলবলয়িতবহলমদকলরিতুরগতরণিচারণচারুভটচমুসভারসংরম্ভনির্ভরভয়ভীতরিক্ত-মুক্ত-কুন্তলপলায়মানবিকলসকল সৈন্যেন স্বতঃ ক্ষয়াতিশয়মাসেদুষা সহ সহসৈব বলদ্বিপর্য্যয়কোটিকষ্টতরসমরমারভ্য নিরমজ্জত। রামাধিকারিতাং রামপালস্য তস্মিন সময়ে নিগড়বদ্ধস্য আধির্মানসী ব্যথা তৎকরণশীতলতাং দধতি এতদগ্রে স্ফূটয়িষ্যতি – রামচরিত ১।৩১, ১।২৯ টীকা)। দ্বিতীয় মহীপালদেবের পরে দ্বিতীয় শূরপালদেব পাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বররূপে ঘোষিত হইয়াছিলেন। তখন রাজ্যচ্যুত, রাজধানী হইতে তাড়িত ভ্রাতৃগণ এক স্থান হইতে অন্যস্থানে পলায়নপর বলিয়া বোধহয় সন্ধ্যাকরনন্দী শূরপালের রাজ্যপ্রাপ্তির বিশেষ উল্লেখকরেন নাই। মনহলিতে আবিষ্কৃত তাম্রসাসনে দ্বিতীয় শূরপালদেব সম্বন্ধে কথিত হইয়াছে যে, ‘মহেন্দ্রতুল্য মহিমান্বিত, স্কন্দতুল্য প্রতাপশ্রীসম্বলিত, সাহসসারথী, নীতিগুণসম্পন্ন শ্রীশূরপাল নামক নরপাল তাঁহার(দ্বিতীয় মহীপালের) এক অনুজ ছিলেন(তস্যাভূদনুজো মহেন্দ্রমহিমাক(স্ক)ন্দঃ প্রতাপশ্রিয়া/ মেকঃ সাহস-সারথির্গুণনয়ঃ শ্রীশূরপালো নৃপঃ।/ যঃ স্বচ্ছন্দ-নিসর্গগ-বিভ্রমভরা(ন) বিভ্রৎ(সু) সর্বায়ুধ/ প্রাগলভ্যেন মনঃসু বিস্ম-ভয়ং সদ্যস্ততান দ্বিষাং।। ১৫ – গৌড়লেখলামা)।’ শূরপাল অন্ততঃ কয়েক দিনের জন্যেও গৌড়েশ্বর ঘোষিত না হইলে মদনপালের প্রশস্তিকার কখনই তাঁহাকে নরপতি বলিয়া উল্লেখ করিতেন না।
No comments:
Post a Comment