ঘুষ দিয়ে চাকরির জীবনে রাইটাররা ফ্যাক্টর থেকে জুনিয়ার থেকে সিনিয়র মার্চেন্ট পদে উন্নীত হত, কিন্তু তাঁদের মাইনে কহতব্য ছিল না। ফলে রাইটারদের চাকরির জন্য ঘুষের অর্থ উসুল করতে প্রাইভেট ট্রেড এবং দুর্ণীতি অনিবার্য ছিল। তাঁর পর এদেশে এসে যদি দেখা যায় প্রশাসনের মাথারা দুর্ণীতির সঙ্গে লেপ্টেলুপ্টে রয়েছে তাহলে নিচের তলার মানুষরা কি করে হাত গুটিয়ে থাকে। ১৭৭৬এ রিচার্ড প্রাইসকে উদ্ধৃত করে এন্থনি পাগডেন পিপলস অ্যান্ড এম্পায়ারএ বলছেন, নবোবরা শুধুই লুঠ আর ধ্বংস করতে ভারতে গিয়েছে। নবোবদের দুর্ণীতি চোখে পড়লেও সে সময়ের ব্রিটিশ রাষ্ট্রের দুর্ণীতির শেকড় অনেকদূর চরিয়েছিল – তা ঔপনিবেশিকদের চোখ এড়িয়ে যায়। ব্রিটিশ অভিজাত দুর্ণীতিবাজেরাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পৃষ্ঠপোষক ছিলন। এই বিতর্কে খলনায়ক হয়ে দেখা দিল ভারতের সমাজ-সংস্কৃতি - ব্রিটিশদের চোখে যা দুর্ণীতিপরায়ন, ক্রুয়েল, ডেস্পটিক, পাগান এবং ডেকাডেন্ট। ফলে ব্রিটেনের সমাজকে ধোয়া তুলসিপাতা করে তুলতে তার তুলনায় ভারতকে ইনফিরিয়র ঘোষণা করতে হল। তবে বিপ্লবী ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধ করে যে ক্ষতি সহ্য করতে হয়েছে ব্রিটেনকে, সেই ক্ষত পুরণ করার সামর্থ্য রয়েছে শুধু নবোবদের, ভারতের লুঠেরা নবোব প্রশাসদের, এই সত্যটাও পরিষ্কার হচ্ছিল মেট্রোপলিসে। নিকোলাস ড্রিকস বলছেন তখন বলা হতে থাকল ধর্ষণের অপরাধ গৌণ হয়ে যায় যদি দেখা যায় ধর্ষিতা বেশ্যা ছিল। এবং নিজেদের বাঁচাতে দক্ষিণ এশিয় সংস্কৃতি যে নষ্ট, দুর্ণীতিগ্রস্ত এবং স্ক্যান্ডেলাস এ তথ্য নতুন করে বলা হতে থাকল বারবার। ভারতকে নেশার রাজ্য বলে দাগিয়ে দেওয়া হল।
ফলে অষ্টাদশ শতের শেষ দিক থেকে নতুন এক ধারণা সভ্যতার দায়কে তুলে ধরা হতে থাকল। উচ্চতম মানসিকতাযুক্ত ব্রিটিশদের কাজ হল ভারত উদ্ধার। টিলম্যান নেকটম্যান ডিফাইনিং দ্য ইন্ডিয়ান এমপায়ারে বলছেন, কড়া হাতে ভারতে প্রশাসন চালানো নবোবদের কিছুটা ছাড়ের দৃষ্টিতে দেখা হতে শুরু করল। ওদিকে আবার ম্যাক্সিন বার্গ আর এলিজাবেথ ইগার লাক্সারি ইন এইট্টিন্থ সেঞ্চুরিঃ ডিবেটস, ডিজায়ার আন্ড ডেলেকটেবল গুডস বইতে বলছেন, ক্ষমতায় থাকা মুক্তবুদ্ধি(এনলাইটমেন্ট)র মানুষেরা লাক্সারিকে পজিটিভ ফোর্স হিসেবে দেখার চেষ্টা করল, বলল এটি সভ্যতা বিকাশের অন্যতম পথ। এর সাহিত্যিক প্রকাশ ঘটল ১৭১৪ সালে ম্যান্ডেভিল বার্নার্ডের দ্য ফেবল অব বিইজএর মত রাজনৈতিক ব্যাঙ্গে। তিনি দেখালেন জনগণের উদ্ধারের জন্য অভিজাতদের ব্যক্তিগত লাক্সারি জরুরি। পরে এর নাম হল ম্যান্ডেভিল প্যারাডক্স।
নবোব নিয়ে লেখা পড়তে পারেন - মেইকি ফেলিঙ্গারের অল মেন্স পলিউশন ডাজ দ্য সি ক্লিন্সঃ রিভিজিটিং দ্য নবোবস ইন ব্রিটেন ১৭৮৫-১৮৩৭ - নবোবস ইন ব্রিটেন এবং নবোবস ইন ইংল্যান্ড বই থেকে)) ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের লাভ যাতে লন্ডনে পৌঁছায়, তাঁর জন্য তার সরকারি পদ অবলম্বন করে চুঁচুড়ায় ডাচেদের, চন্দননগরে ফরাসীদের আর শ্রীরামপুরে দিনেমারদের সঙ্গে দ্বৈত রফায় এলেন প্যাক্সটন। ইওরোপিয় কোম্পানিরা যেমন ভারতে এসে ব্যবসার জন্য অতিরিক্ত বাটা ছাড়াই সিক্কা রূপো টাকা পাওয়ার অধিকারী হল, তেমনি, তাঁদের হাত দিয়ে বিভিন্ন ইওরোপিয় দেশের বিল এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে লন্ডনে টাকা পাঠানো সোজা হল। প্যাক্সটনের আমলে ১৭৭৭ থেকে ব্রিটিশ ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীদের লাভ চুঁচুড়ায় ডাচ ট্রেজারিতে সিক্কা রূপিতে জমা করা শুরু হল। সেই টাকা লন্ডনে পৌছে যেত অবলীলায় বিল এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে। ১৮৮১ সালে তিনি ডাচেদের ১০লক্ষ সিক্কা রুপি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন, যা আদতে ডাচেদের বাংলার ব্যবসার অর্ধেক বিনিয়োগ বা ইনভেস্টমেন্ট।
এই সম্পদ-রপ্তানির পরিকাঠমো তৈরি করার পাশাপাশি তাঁর ক্লায়েন্টদের জন্য প্যাক্সটন, ককরেলের এজেন্সি হাউস এই সেবাগুলি দিত, যে সূত্র ধরে পরে এজেন্সি হাউসগুলো গড়ে উঠেছিল -
১। কোম্পানি চাষী আর ব্যবসায়ীদের হয়ে নানান দ্রব্য কিনত হ্যান্ড নোটের বিনিমিয়ে;
২। বাজারের দাম বাড়লে সেই দ্রব্যগুলি ব্যবসায়ীদের হয়ে উচ্চদামে বাজারে বিক্রির ব্যবস্থা করত তারা, পণ্য বিক্রি হয়ে গেলে সেই অর্থ ব্যবসায়ীর একাউন্টে দিয়ে দেওয়া হত নির্দিষ্ট কমিশনের বিনিময়ে;
৩। কয়েকজন ব্যবসায়ীর পণ্য একসঙ্গে জড়ো করে সেগুলি শিপিং কোম্পানিকে বিল অব এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে দেওয়া হত। ফলে ব্যবসায়ীদের স্থানীয় অর্থ বিনিময় করতে কোম্পানিকে নতুন করে বাটা দেওয়ার প্রয়োজন হত না, যা করার প্যাক্সটন কোম্পানি করত;
৪। প্যাক্সটন নিজে তাঁর পদের মর্যাদা আর সরকারি যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে ইওরোপের কয়েকটি দেশের সঙ্গে এমন কিছু বিল অব এক্সচেঞ্জ নিয়ন্ত্রণ করতেন যা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আইনের আওতার বাইরে ছিল। ফলে ট্যাঁকশালে চাকরির ঘোমটার আড়ালে তাঁর ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে।
No comments:
Post a Comment