বাংলার নিজস্ব প্রচুর পণ্য তো ছিলই, কিন্তু বাংলার মূল ব্যবসা ছিল বিভিন্ন আন্তরাজ্য, আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহনের মাঝের দাঁড়ি(ট্রাঞ্জিট পয়েন্ট)। এটা মনে রাখা দরকার। ঐতিহাসিকভাবে বাংলায় ঘোড়া আমদানি হত। এগুলি আসত তুর্কি, পারস্য থেকে। এখান থেকে নানান ভাবে এশিয়ার নানান দেশে যেত। তুর্কি(ইংরেজদের ভাষায় টাট্টু) ঘোড়া সোজাসুজি তুর্ক প্রদেশ থেকে চলে যেতে পারত চিনে, কিন্তু বাস্তবে তা হত না। সেগুলি বাংলায় আসত হয় গুজরাট বন্দর হয়ে বা আফগানিস্তান হয়ে গঙ্গার দুপাশের মধ্যে উত্তরের রাস্তা ধরে শোনপুর মেলা হয়ে বাংলায়। আর একদল দক্ষিওণের রাস্তা ধরে দাক্ষিণাত্যে গিয়ে আসত বাংলায় জল বা স্থলপথে ঘোড়া নিয়ে।
এই তাত্ত্বিক প্রেক্ষিতে আমরা বাংলার বাণিজ্য ও যোগাযোগ অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করব। মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলা আর ঢাকার রাজনগর বড় ব্যবসা কেন্দ্র। এছাড়া বাংলা জুড়ে ছিল বিচিত্র পণ্যের বৈচিত্র্যতম বাজার। বড় মহাজন থেকে ছোট দোকান পর্যন্ত এই শৃঙ্খলে যুক্ত ছিল। উৎপাদকেরা যেমন তাদের কিছুটা অতিরিক্ত উৎপাদন তার নির্দিষ্ট বাজারের বাইরে পাঠাত, তেমনি তার মূল উৎপাদন বিক্রি করত কিন্তু আঞ্চলিক বাজারে, এক জেলা থেকে অন্য জেলায়। কিছু কিছু সওদাগর বণিক এক একটা পণ্য বাজারে প্রায় একচেটিয়া ক্ষমতা ভোগ করত, যেমন খ্বাজা ওয়াজেদ, লবণের ব্যবসায় একচেটিয়া কারবার করত। তেমনি চট্টগ্রাম আর শ্রীহট্ট অঞ্চলে ফৌজদারেরা বেশ কিছু পণ্যের ওপরে একচেটিয়া বাণিজ্য অধিকার কায়েম করেছিলেন। অন্যদিকে বহুকাল ধরেই শুধু ব্রিটিশ কোম্পানির কর্মচারী, কোম্পানির প্রাক্তন কর্মচারী(ইন্টারলোপার্স) বা সাধারণ ব্রিটিশ ব্যবসায়ী(ফ্রি মার্চেন্টস)রাই নয়, কোম্পানির একচেটিয়া সনদের অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করে ব্যক্তিগত ব্যবসা করত অন্যান্য ইওরোপিয় কর্পোরেট কোম্পানির কর্মচারী ও সেই দেশিয় বণিকেরা।পলাশীর পরে ব্রিটিশদের হাতে কার্যকর ক্ষমতা চলে আসায়, ব্রিটিশ কোম্পানি, অন্যান্য ইওরোপিয় কোম্পানিকে, বাংলায় ব্যবসা দখলের মত করে বাংলা বাজার থেকে বার করে দিল।
ইওরোপিয় বণিকেরা এবং কোম্পানিরাও এদেশিয় ব্যবসায়ী এবং দালালদের বাজারের জ্ঞান, পুঁজি, ব্যবসায়িক বুদ্ধি, সাংগঠনিক বুদ্ধি ধার করত। ইওরোপিয় বণিকেরা ২০ থেকে ৩০ শতাংশ লভ্যাংশ পেত। সমককালীন ব্যবসার হিসেবপত্রে দেখা যায় বাংলার চালের ব্যবসায় মোটামুটি লাভের পরিমান থাকত ২০-২৫ শতাংশ। পণ্যের দাম সারা বছর ঠিক থাকে না, বাড়ে বা কমে। সেই অনুযায়ী লভ্যাংশ ঠিক হত।
প্রাক পলাশী সময়ে ডাও সূত্রে জানতে পারছি, বাংলা শুধু যে আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের বড় শক্তি ছিল তাই নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তার আবশ্যিক বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। তার বাণিজ্য বিস্তার ছিল অসম ভূটান তিব্বত নেপাল থেকে পশ্চিমের গুজরাট, উত্তরে কাশ্মীর এবং উত্তরভারতের বিভিন্ন অঞ্চল, আর দক্ষিণের করমণ্ডল আর মালাবার উপকূল। এছাড়া পশ্চিম উপকূল বোম্বাই আর সুরাটের(দুটিই তখন গুজরাট রাজ্যে অবস্থিত ছিল) সঙ্গে ভাল যোগাযোগ ছিল – সুরাটের একটি বন্দর দিয়ে বাংলার সুপারি যেত বলে সেই বন্দরটির নামই হয়ে গেল সোপারা। গঙ্গার দুপাশ দিয়ে যে রাস্তা বাংলাকে পশ্চিম আর উত্তর ভারতের সঙ্গে জুড়েছিল, সেই রাস্তা ধরে বাণিজ্য হত।
সাধারণত মির্জাপুর দুই এলাকার মধ্যিখানের ঘাঁটি হিসেবে কাজ করত। উত্তর মধ্য ভারতের দিল্লি, আগ্রা, এলাহাবাদ, অযোধ্যা, কাশী, বুন্দেলখণ্ড ও মালবের সঙ্গে বাংলার ঘনিষ্ঠ ব্যবসা সম্পর্ক ছিল। এ সময়ে বাংলায় ব্যবসা করতে আসত আফগান, শেখ, কাশ্মীরি, মুলতানি, পগেয়া(পাগড়িধারী উত্তরভারতের ব্যবসায়ি, যে জন্য কলকাতায় আজও পগেয়াপট্টি নাম আছে), ভুটিয়া এবং সন্ন্যাসীরা। সন্ন্যাসি আর ফকিরেরা হিমালয়ের উদ্ভিজ্জ, ফসল, চন্দনকাঠ, নানান ধরণের বীজ, রুদ্রাক্ষ, ভেষজ দ্রব্য আর গাছগাছালি বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে আসত। হলওয়েলের সূত্রে জানতে পারছি দিল্লি আগ্রা থেকে বণিকেরা বর্ধমানে বাণিজ্যের জন্য আসত এবং টিন, সীসা, তামা, লঙ্কা আর নানান রকম কাপড় নিয়ে যেত। বিনিময়ের অঙ্কে বিশাল বাণিজ্য করত এই বণিকেরা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলি নগদ মুদ্রায় কিনত। কিছু পণ্য বিনিময়ে হাত বদল হত। আফিম সোরা আর ঘোড়ার বিনিময়ে তারা চাল, ডাল ইত্যাদি খাদ্য দ্রব্য সংগ্রহ করত।
উল্টোটা ঘটত বাংলার বণিকদলের ক্ষেত্রে। এরা ঐ অঞ্চলে নিয়ে যেত লবণ, চিনুই, রেশম, রেশমি কাপড়, অসংখ্য সুতির কাপড় আর মসলিন। রেনেল(আ ফিলজফি এন্ড পলিটিক্যাল হিস্ট্রি অব দ্য সেটলমেন্টস) বলছেন আগ্রা দিল্লির সঙ্গে বাংলার বাৎসরিক বাণিজ্য পরিমান দাঁড়াত চার কোটি টাকা(১৭,৫০,০০০ পাউন্ড)। বাংলার বণিকেরা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যবসা করতে যেত, অসম্ন, নেপাল, কাছাড় থেকিএ আনত কাঠ আর হাতর দাঁত আর বনজ দ্রব্য। বালেশ্বরে পাঠাত তামাক। অসমেও পাঠাত লবণ, তামাক সুপারি। পূর্ব পশ্চিম উপকূলের বন্দর, শহর, দিল্লি আগ্রায় বাংলার বণিকদের দেখা যেত। তারা বাংলা থেজে নিয়ে যেত সূতির কাপড়, রেশমি কাপড়, মসলিন, চিনি, তামাক, সুপারি, লবণ, আদা, হলুদ, লঙ্কা ইত্যাদি। বাংলায় তারা নিয়ে আসত ফল, ওষুধ, কড়ি, টিন। তুলো, শঙ্খ ইত্যাদি। কাশ্মীরী আর আর্মেনিয়রা বাংলার ব্যবসায় বিপুল অংশগ্রহন করত। কাশ্মীরী বণিকেরা বাংলা থেকে লবণ সংগ্রহ করত। মালঙ্গীদের সঙ্গে তাদের দাদনের ব্যবস্থা থাকত…। এরা আন্তঃরাজ্য ব্যবসা করত। বাংলা থেকে লাপড়, রেশম, ঝিনুক, চামড়া, নীল, মুক্তো, তামাক, চিনি, লবণ, সুপারি, মশলা, ব্রডক্লথ, লোহার জিনিসপত্র, মালদা-সাটিন নিয়ে নেপাল, তিব্বত আর ভূটানে যেত। বাংলার নানান অঞ্চলের জন্য নানান ত্রকম ভেষজ, সোনা, রেশম, হাতির দাঁত, পশমের কাপড়, মুখোশ আর লাক্ষা নিয়ে আসত।
(ক্রমশঃ)
(ক্রমশঃ)
No comments:
Post a Comment