পলাশির পর এতদিন যে কাজটা ইনিয়ে বিনিয়ে কর্তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে-চুরিয়ে হত, সেই কাজটা তাঁরা সাজিয়ে নিলেন এমন ভাবে যাতে বেআইনি মনে না হয়। তাঁর পদের সুযোগ নিয়ে, তিনি ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীদের লাভ যে চোরাই, বেআইনি নয়, এই শংসাপত্র দিতেন এবং লন্ডনে তাঁর টাঁকশালের একাউন্টে পাঠাবার ব্যবস্থা করতেন। সেখান থেকে সেগুলি হাত বদল হত। তিনি/কোম্পানি এই কাজটি করতে অ্যাসেসি পরামর্শ ফি, এবং মোট স্থানান্তরিত সম্পদের ওপর একটা অংশ দাবি করতেন। তিনি যে পরিকাঠামো গড়ে দেন, তা অবলম্বন করে বাংলার সম্পদ লুঠ করে ইওরোপে নিয়ে যেতে সুযোগ করে দেয়। এছাড়া ভারতে যুগান্তকারী এজেন্সি হাউস প্রথার পথিকৃত হয়ে ওঠে তাঁর প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি।
প্যাক্সটনের ফাঁকির কারবার বুঝে ফেলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তারা ভারত থেকে লন্ডনে অর্থ রপ্তানির মাত্রা বেঁধে দেয়। তাদের নজর এড়িয়ে কোম্পানির লাভের বাইরের অতিরিক্ত অর্থ সরকারিভাবে লন্ডনে পাঠানো মুশকিল হল। অথচ বিভিন্ন ব্যক্তিগত ব্যবসা, নবোবদের সংখ্যা বেড়েই চলছিল, লন্ডনে তখন শিল্প বিপ্লবের জোয়ার, ভর্তুকি চাই আরও আরও ভর্তুকি – ফলে ইন্টারলোপার্সদের কোম্পানি অপছন্দ করলেও, সাম্রাজ্যের বিস্তারের জন্য তাঁদের বাংলা লুঠের উদ্বৃত্ত সম্পদ প্রয়োজন তা আম ব্রিটেনবাসী বুঝছিলেন। তাই আরও বেশি লুঠের লাভের কড়ি লন্ডনে পাঠানোর পরিকাঠামো তৈরি করতে হচ্ছিল, কোম্পানির নিয়ন্ত্রণের বাইরে, কিন্তু সাম্রাজ্যের নৈতিকতার মধ্যে থেকেই।
প্যাক্সটনদের রমরমার বাজার শুরু হল অর্থ রপ্তানির হাঁসফাঁস আলগা করার কাজ করতে গিয়ে। ব্রিটিশরা বাংলা সুবায় ক্ষমতায় আসার পর অন্য ইওরোপিয় দেশগুলির বাংলার ব্যবসা মার খেতে শুরু করে। ডাচ কোম্পানি বিষয়ে অসাধারণ গবেষক ওম প্রকাশজী দেখিয়েছেন কিভাবে ক্ষমতায় এসে ব্রিটিশরা অন্যান্য ইওরোপিয় ভাইদের বাংলা-ভারতীয়-এশিয় ব্যবসা থেকে হঠিয়ে দিতে উঠে পড়ে লাগে। এই ক্ষতির সঙ্গে জুড়েছিল জাহাজডুবি, ইওরোপ থেকে বাংলায় প্রায় ফাঁকা জাহাজ নিয়ে আসা সহ অন্যান্য ক্ষতি। কিন্তু তাদেরও তো ব্যবসা করতে হবে। লাভ করতে তাদের প্রয়োজন ছিল ব্রিটিশ প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা।
প্যাক্সটন তাঁদের মসিহারূপে উদয় হলেন। ইন্টারলোপার্সদের সঙ্গে চুক্তি হল তিনি তাঁদের সিক্কা রূপির বাটা ছাড়া দেবেন, বিনিময়ে তাঁরা ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীদের লাভের গুড় তাঁদের দেশ মার্ফত লন্ডনে পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন। লন্ডনে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলাদের এডিয়ে, বাংলার বড়লাট হেস্টিংসকে হাত করে(তাঁর প্রধান অংশীদারদের সঙ্গে হেস্টিংসের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল তা আমরা পরে যেমন দেখব; তেমনি লন্ডন থেকে বাংলা, যেখানেই হোক, কোম্পানির মুড়ো থেকে গোড়া পর্যন্ত আমলাদের ঘুষ দিয়ে যে কোন কাজ করিয়ে যে নেওয়া যেত, এ তথ্যটি তখনকার কোম্পানির ভাগ্যের সঙ্গে জুড়ে থাকা সক্কল ব্রিটিশ জানত। ঘুষের পরিমানটা কেমন ছিল? ফিলিপ লসন এবং জিম ফিলিপ আওয়ার এক্সারেবল ব্যান্ডিটির ২২৭ পাতায় বলছেন, কোম্পানির নিম্নতম পদ রাইটার (কেরাণী)হিসেবে যোগ দেওয়ার শংসাপত্রর জন্য একজন ডিরেক্টর ৪০০০ পাউন্ড (ঘুষ) নিতেন।
যখন ৮০০ পাউন্ডে লন্ডনে বছরে রাজার হালে থাকা যেত) ফলে রাইটারেরা – আদতে ভবিষ্যতের নবোবেরা সাধারণতম ঝড়তি পড়তি পরিবারগুলি থেকে আসত এই ঔপনিবেশিক ধারণাটির মূলে কুঠারাঘাত করেছে। সে সময় লন্ডনে বা সারা ইংলন্ডে হাতে গোণা পরিবার ছিল যারা তাঁদের উত্তরাধিকারীর বিদেশে চাকরির জন্য একলপ্তে ৪০০০ পাউন্ড ঘুষ দিতে পারত এবং তা দিতেও পিছপা হত না – এবং তাঁদের উচ্চমহলে সেই বিপুল পরিমান অর্থ ঘুষ দেওয়ার তৈলমর্দনী যোগাযোগটাও থাকত। লন্ডনে বা ঔপনিবেশিকতায় নিষিক্ত ভারতেই হোক, বা মেকলের পুত্রকন্যানাতিনাতনিদের মনস্তত্ত্বের মূলে ছিল ধনীরা দুর্ণীতির আশ্রয় নিতে পারে না – তাই ভারতের পাঠ্য পুস্তকে পড়ুয়াদের সে দরিদ্র অথচ সৎ গোছের বাক্য ইংরেজিতে অনুবাদ করতে দেওয়া হত। ভারত থেকে চরম ধনী হয়ে আগত নবোবেরা সাধারণ দরিদ্র পরিবার থেকে আসত তাই দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল, এই প্রচারের মাধ্যমে ধনীরা তাদের সামাজিক আর্থিক আর ক্ষমতার দুর্ণীতি থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত।
এ প্রসঙ্গে আমরা দেখিয়েছি উইলিয়ম বার্ক তার বিখ্যাত ইম্পিচমেন্ট বক্তৃতায় কিভাবে কোম্পানির সাধারণ আমলাদের দুর্ণীতিকে আড়াল করতে ভারতীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থার দুর্নীতি ওপর দায় চাপিয়ে কাজ সেরেছেন। উইলিয়াম ডি রুবিন্সটেইন তার দ্য এন্ড অব ওল্ড কোরাপশান ইন ব্রিটেনঃ ১৭৮০-১৮৬০এ বা ফিলিপ হার্টিঙ্গের দ্য ওয়ানিং অব ওল্ড কোরাপশনঃ দ্য পলিটিক্স অব ইকনমিক রিফর্মস ইন ব্রিটেন ১৭৭৯-১৮৪৬এ বলছেন দুর্ণীতি আর ঘুষ ব্রিটেনের সাধারণ ঘটনা ছিল। রুবিন্সটেইন সরাসরি বলছেন সুবিধে দেওয়া/উপঢৌকন(গ্রাচিটিউড), ঘুষ নেওয়া, অযোগ্যদের অবসরের সুযোগসুবিধে পাইয়ে দেওয়া বা পারিবারিক প্রভাব খাটানো অষ্টাদশ শতকের ব্রিটেনের অভিজাত সমাজের স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। ল্যান্ডেড জেন্ট্রিদের নিজেদের মধ্যে এই দুর্ণীতির শৃংখলের রেশ ছড়িয়ে পড়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দৈনন্দিন কাজকর্মে দুই শ্রেণীর পারস্পরিক লেনদেনের মাধ্যমে। সেই সময়ের লন্ডনের অভদ্রলোকিয় সাধারণের(লিন্ডা কোলি ব্রিটন্স, পাসিম বইতে বলছেন আমলাদের অধিকাংশই আসতেন চাকরিজীবী মধ্যশ্রেণীর পরিবারগুলি থেকে – যদিও কোম্পানির কাজকর্মের প্রতিবাদীর ভূমিকা অধিকাংশই পালন করেছেন এই মধ্যশ্রেণীর মানুষেরা – তবুও মধ্যশ্রেণী আর ধনিক আর ল্যান্ডেড জেন্ট্রিদের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থ-নির্ভরতার লেনদেনও বেশ ছিল। দুপক্ষই তা বিলক্ষণ জানতেন।
এবং এই স্বার্থ-নির্ভরতা কিন্তু ব্যতিক্রমী ঘটনা ছিল না, বরং তা সাধারণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি ছিল। তিনি বলছেন এই মধ্যবিত্তরা শুধু যে নবোরা ছিল তাই নয়, ছিল ট্রান্সআটলান্টিক ব্যবসায়ী, দোকানদার, অন্যান্য পেশাজীবী এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের দাস ব্যবসায়ী প্লান্টার্সরাও ছিল – পরে দাস ব্যবসা বেআইনি হয়ে যাওয়ার সময় এদের নিয়ে আরেক দফা বিতর্ক হয়ে ১৮০৭ সালের আইনে রূপান্তরিত হয়। মার্গারেট ফিন তার দ্য ক্যারেকটার অব ক্রেডিটঃ পার্সোনাল ডেট ইন ইংলিশ কালচার ১৭৪০-১৯১৪তে সরাসরি বলছেন কিভাবে এই ল্যান্ডেড জেন্ট্রি থেকে মধ্যবিত্তরা ঋণ নিতেন সেই গল্প। আবার উল্টোটাও ঘটত জেমস হোলজম্যান নবোস ইন ইংল্যান্ডে বলছেন ১৭৯৩ সালে এক বিখ্যাত নবোব পল বেনফিল্ড সরকারি কর্মচারী আর অভিজাতদের ঋণ দেওয়ার জন্য বয়েড, বেনফিল্ড এন্ড কোং খুলে বসে সর্বস্বান্ত হন এবং মেকলের পুত্র কন্যারা কিন্তু এই ধরণের উল্টো পথের গবেষণা করতে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামান নি – লিন্ডা বলছেন, আদতে এই ধরণের সহজ শর্তে ধার দেওয়া নেওয়ার যে পারস্পরিক নির্ভরতা গড়ে উঠেছিল সে সময়ের ব্রিটেনে সেটিই আদতে পারস্পরিক নির্ভরতা আর অবলিগেশনের প্রমান।) মনের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে দুর্ণীতিবাজ, গুণ্ডা(ক্রিমিন্যাল) এবং সামাজিক মই দিয়ে ওপরে ওঠা মানুষদের সংঘ ছিল – এই ধারণা দৃঢ হয়ে বসে। নবোবেরা যে দুর্ণীতিবাজ, গুণ্ডা এবং তাঁদের ধনপ্রাপ্তি ঘটেছিল দুর্ণীতির আশ্রয় নিয়ে এই মনোভাব তীব্র হয়ে ওঠে ১৭৮৫ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস দেশে ফিরে এলে এবং তার দুর্নীতির বিচার ঘটনায়)
No comments:
Post a Comment