ফারসি এ সময়ের দরবারের ভাষা। শহুরে প্রখ্যাতরা সক্কলেই ফারসি শিখতেন। ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ, রাজা নবকৃষ্ণ আর ধর্মমঙ্গলের কবি নরসিংহ বসু ভাল ফারসি জানতেন। পাটনার উপদেওয়ান রামনারায়ণ ফারসি আর উর্দুতে কবিতা লিখতেন। মুঘল আমলের মতই নবাবদের দরবারের অমুসলমান আমলারা ফারসি জানতেন। লুক স্ক্রাফটন তার রিফ্লেকশন...এ বলছেন অভিজাত মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য হল, আরবি ফারসি লিখতে পড়তে পারা, গাম্ভীর্য ও বিচক্ষণতা অর্জন, আবেগ আর অধৈর্যভাব দমন এবং অশ্বাহরোণ ও অস্ত্রালোচনা শিক্ষা। অন্যান্য অভিজাতদেরও একই ভাবে গড়ে উঠতে হত। কৃষ্ণচন্দ্রের পিতা রঘুরাম অস্ত্রচালনায় ও ধনুর্বিদ্যায় পারদর্শী হয়েছিলেন।
গোলাম হসেনের সিয়ার-এ আলিবর্দির দরবারের উজ্জ্বল নক্ষত্রদের তালিকা হল, মৌলভি শাস্ত্রজ্ঞ নাসের, দাউদ আলি খাঁ বা জাহির হসেন খাঁ, কবি মির্জা মহম্মদ মুসেবি খাঁএর শিষ্য মীর মহম্মদ আলিম, ইসলামি শাস্ত্রজ্ঞ মৌলভি মহম্মদ আরিফ, মীর রুস্তম আলি, কোরাণ বিশেষজ্ঞ মাহমেদ আমিন, আহ আধেম, হায়াত বেগ, ধর্মজ্ঞ শাহ খিজরি, ধর্মপ্রাণ সৈয়দ মীর মাহমদ সাজ্জাদ, স্বয়ং গোলাম হোসেনের পিতামহ সৈয়দ আলিমুল্লাহ, শাহ হায়দারি প্রমুখ। আলিবর্দি পাটনার বিখ্যাত পণ্ডিত কাজী গোলাম মজফফরকে মুর্শিদাবাদের প্রধান বিচারক করেছিলেন। সুজার চিকিৎসক ছিলেন হাদি আলি খাঁ। সে সময়ের মুর্শিদাবাদের তার পরিবার চিকিতসাবিদ্যা, পাণ্ডিত্য ও শাস্ত্রজ্ঞানের জন্য প্রখ্যাত ছিলেন। আলিবর্দি হাদি আলিকে বাৎসরিক ১৪০০০ টাকা বেতন দিতেন। পুত্র মহম্মদ হোসেব খাঁও প্রখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন। হাদি আলির ভাই নাকি আলি খাঁ, সম্রাট মহম্মদ শাহের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন(আব্দুল মজিদ খাঁ – দ্য ট্রাঞ্জিসন ইন বেঙ্গল)। এই পরিবারেই রেজা খাঁএর জন্ম, তিনি হাদি আলির তৃতীয়পুত্র ছিলেন।
এ সময়ে নদীয়ার বাংলার অমুসলিম শিক্ষা ও কৃষ্টির সবচেয়ে বড় কেন্দ্র। অন্য দুটো বর্ধমান আর রাজনগর ঢাকা। দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্র রায় সূত্রে পাচ্ছি, কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বে নবদ্বীপে ন্যায়িকদের মধ্যে ছিলেন হরিরাম তর্ক সিদ্ধান্ত, কৃষ্ণানন্দ বাচস্পতি, রামগোপাল সার্বভৌম এবং প্রাণনাথ ন্যায়পঞ্চানন। ধর্মশাস্ত্রে পণ্ডিতদের মধ্যে ছিলেন গোপাল ন্যায়ালঙ্কার, রামানন্দ বাচস্পতি এবং বীরেশ্বর ন্যায়পঞ্চানন। দর্শনশাস্ত্রে শিবরাম বাচস্পতি, রমাবল্লভ বিদ্যাবাগীশ, রুদ্ররাম তর্কবাগীশ, শরণ তর্কালঙ্কার, মধুসূদন ন্যায়লঙ্কার, কান্তবিদ্যালঙ্কার এবং সঙ্কর তর্কবাগীশ। গুপ্তিপাড়ার কবি ছিলেন বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, ত্রিবেণীতে জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন, শান্তিপুরে রাধামোহন গোস্বামী ভট্টাচার্য। জ্যোতিষে রামরুদ্র বিদ্যানিধি আর অবশ্যই দুই কালজয়ী রামপ্রসাদ আর ভারতচন্দ্র আর কবি বাণেশ্বর।
ঢাকার রাজনগরে রাজবল্লভ চতুষ্পাঠী, টোল, মক্তব, পাঠশালা স্থাপন করেন। তিনি যে তিনজন মেধাবীকে নবদ্বীপে পাঠিয়েছিলেন, তাঁরা নীলকণ্ঠ সার্বভৌম, কৃষ্ণদেব বিদ্যাবাগীশ এবং কৃষ্ণকান্ত সিদ্ধান্ত রূপে ফিরে এসে রাজনগরে বিদ্যাশিক্ষা দেন।
বাংলায় একমাত্র কোচবিহার, ত্রিপুরা আর অসমে বাংলা রাজভাষা ছিল। সেখানে রাজকাজ যেহেতু বাংলায় হত তাই দলিল, চিঠি ইত্যাদি বাংলাতেই লেখা হত। বাংলায় বহুকাল ধরেই অভিজাতরা বাংলাকে অবজ্ঞার চোখে দেখতেন। বাংলায় যত পণ্ডিতি লেখা হয়েছে তার অধিকাংশ সংস্কৃততে। এমনকি প্রথাগত কৃষ্টির বাইরে থাকা তন্ত্রও সংস্কৃতঘেঁসা বাংলা লিখেছে। আর যারা কিছুটা হলেও ‘যবন’ বিরোধী ছিলেন, তারা ফারসিকে সংস্কৃত দিয়ে প্রতিস্থাপিত করেছিলেন।
জেমসলং ক্যালকাটা ইন ওল্ডেন টাইমসএ লিখছেন, ১৭৫৪/১১৬১তে পাদ্রি ম্যাপলটফট কলকাতায় ইংরেজি বিদ্যালয় খোলার আবেদন করেন দুটি যুক্তিতে, কোম্পানি শস্তায় কর্মচারী পাবে আর জমিদারদের কিছুটা সুবিধে হবে। এরপর মিশনারিরা প্রচুর চেষ্টা চালিয়েছেন। সিলভেস্টার বাংলায় খ্রিস্ট মিশনারি পুস্তিকা ছাপিয়েছেন। কিন্তু তখনও ইংরেজি শেখায় বাংলার আগ্রহ দেখা যায় নি। এডোয়ার্ড ঈভস ভয়েজ...এ লিখছেন, বালকেরা কেউ মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কিছু শেখে না। বাংলায় প্রচুর ইংরেজ থাকে, কিন্তু স্থানীয়দের সংগে তাদের ইংরেজিতে আলাপ খুবেশি হয় না।
No comments:
Post a Comment