বর্গীরা একবার মুর্শিদাবাদে হানাদিয়ে যা পেয়েছিল তা নিয়ে নাগপুরে নিয়ে যায়। দুকোটি আর্কট টাকা লুঠ যেন দুআঁটি খড় চুরির সমান। কিন্তু বর্গীর হামলার পর পড়ে থাকা বাঙলার সম্পদ দেখে, চকচকে চোখ ইংরেজরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাঙলা লুঠের চক্রব্যুহ পরিকল্পনা তৈরি করল। বাঙলা সরকারের প্রতিশ্রুতিতে তিন কোটি টাকায় নতুন লুঠের রাজত্ব শুরু হল। পলাশির চক্রান্তের ফসল তোলা জাফর আলি খান বা মির জাফর উতকোচের অর্থ কোম্পানিকে না দিয়ে ক্লাইভকে দিলেন। ক্লাইভের সঙ্গে যেসব ইংরেজ আমলা ছিলেন তারাও বাঙলা ঘুষের অর্থে ইংলন্ডের ধনীতম মানুষ বনে গেলেন। ১৭৬৫তে ফেব্রুয়ারিতে মীরণের শিশুপুত্রের সিংহাসনের বসার অধিকার খারিজ করে দিয়ে মীরজাফরের অবৈধ পুত্র নাজমুদ্দৌল্লাকে সিংহাসনে বসান তিনজন ইংরেজ, লিসেস্টার, সিনিয়র, মিডলটন। এর জন্য শিশু নবাবের থেকে সাড়ে বাষট্টিলক্ষ টাকা নজরানা পেলেন। সিংহাসনে আদৌ আরেহন করবেন কী না, সে সম্বন্ধে নিজের ভাগ্য পরখ করতে রেজা খাঁ ইংরেজদের দিলেন প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা। এ ছাড়াও সিলেক্ট কমিটির অনেক বড় কর্তাও এই সুযোগে ধনী হলেন।
রোগেভুগে মরে গিয়ে একমাত্র ফাঁকিতে পড়লেন ক্লাইভের পলাশীপূর্ব সঙ্গী এডমিরাল ওয়াটসন। সবাই বখরা পেলেও ওয়াটসনএর উত্তরাধিকারীদেরকে সেই অংশ দেওয়ার কথা বেমালুম ভুলে যান। ওয়াটসনের ভাইবিরাদরিরা ইংলন্ডে আইনের দরজায় দাঁড়ালে ক্লাইভ তাদের নির্দিষ্ট অর্থ নজরানাস্বরূপ পাঠিয়ে দেন। পলাশীর চক্রান্ত থেকে ১৭৬৬ পর্যন্ত দ্বৈত শাসনে বাঙলার নবাবদের সঙ্গে নানান চুক্তি করে কোম্পানির কর্মচারীরা নিজেদের দেশে সে পাঁচকোটিরও বেশি টাকা চালান করে। পলাশী চক্রান্তের ইংরেজদের প্রাপ্য অর্থ মেটাতে গিয়ে শূণ্য তহবিল নিয়ে বাঙলার জনগণের স্বাধীণতা সংগ্রাম ধংস করতে ইংরেজদের সেনা ব্যবহার করল মিরজাফর। বাঙলার স্বাধীণতা সংগ্রাম দমনের শর্ত হল ১৭৬০ থেকে তারা বাঙলার ২৪ পরগণা, বর্ধমান, মেদিনীপুর, চট্টগ্রামের জমিদারি পাবে। খাজনা তুলবে নবাবের বদলে ইংরেজরা। বিশ্বের প্রথম কর্পোরেট আউটসোর্সিংএর কাজ আদায় করল ইংরেজরা। বাঙলা তথা ভারতের খাজনা শাসনযন্ত্রে ইংরেজদের প্রবেশের সেই শুরু, যার শেষ হবে সমগ্র দেওয়ানি আর নিজামত তাদের হতে চলে যাওয়ার সঙ্গে। দেওয়ানি আর নিজামত লাভের সঙ্গে বাঙলার উদ্বৃত্ত রাজস্ব ইংরেজদের অমিতপরিমান বাণিজ্যিক পুঁজি তৈরি হল।
অত্যাচারমূলক লুঠের বাণিজ্য
১৭৬৫ সনের ১৮ই সেপ্টেম্বর ক্লাইব এবং তাহার কৌন্সিলের মেম্বরগণ লবন তামাক ও গুবাকের বাণিজ্য সম্বন্ধে আর কয়েকটি কঠিন নিয়ম প্রচার করিলেন, নবাবের লাভালাভ কিংবা প্রজাসাধারণের সুবিধার প্রতি একবার ভ্রমেও দৃষ্টিপাত করিলেন না। কিন্তু পাছে ডিরেক্টরগণ এই নিয়ম না মঞ্জুর করেন সেই আশংকায় এইরূপ বন্দোহস্ত করিলেন যে লবণ, তামাক, এবং গুবাকের বাণিজ্যে বণিকসভার যে লাভ হইবে তাহাতে শতকরা পাঁচিশ টাকা হারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পাইবেন বাকী টাকা গবর্ণর কৌন্সিলের মেম্বর, সৈন্যাধ্যক্ষ এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সমুদায় ছোট-বড় সমুদায় কর্মচারীগণ স্বীয় স্বীয় পদমর্যাদা অনুসারে ভাগ করিয়া লইবেন। এই বাণিজ্যের লাভ হইতে প্রায় কোন কর্মচারীই বঞ্চিত হইলেন না। খ্রীষ্টধর্ম প্রচারার্থ যে দুইজন ধর্মযাজক(chaplains) কলিকাতায় তত্কালে অবস্থান করিতেন তাঁহারাও কিছু কিছু পাইতেন।
লবণের বাণিজ্য এইরূপ একচেটিয়া করিবার অব্যবহিত পূর্বে ক্যারাপিট আরাটুন নামক জনৈক আরমানিয়ান বণিক ত্রিশ হাজার মণ লবণ গোলায় ক্রয় করিয়া তাঁহার দিনাজপুরস্থ গোলায় মজুদ রাখিয়া ছিলেন। তিনি যখন শুনিতে পাইলেন যে, দেশের সমুদয় লবন ইংরেজরা ক্রয় করিয়া, পরে অত্যাধিক মূল্যে দেশিয় বণিকদেগের নিকট বিক্রয় করিবেন বনিয়া স্থানে স্থানে নবাবের পরওয়ানা জারি করাইয়াছেনব, তখন তাঁহার নিজের গোলার লবন বিক্রয় বন্ধ করিয়ে রাখিলেন। তিনি মনে করিলেন যে এই নিয়ম প্রচারের পর লবণের মূল্য পাঁচগুণ বৃদ্ধি হইবে, সুতরাং সেই মূল্যে বাজারে আপন লবন বিক্রয় করিয়া অন্তত এই বত্সরে কিছু লাভ করিতে পারিবেন, মনে মনে এই সংকল্প করিয়া আরাটুন সাহেব স্বীয় গোম্তাকে লবনের গোলা বন্ধ করিয়া রাখিতে আদেশ করিলেন. কিন্তু ইংরেজগণ তাহার গেলার নবণ আত্মসত্ করিবার অভিপ্রায়ে নানানবিধ অবৈধ উপায় অবলম্বন করিতে লাগিলেন। ত্রিশ হাজারমণ লবণ তাঁর গোলায় মজুদ রহিয়াছে. এখন একটাকা হারে মণ ক্রয় করিতে পারিলেও বাঙালি বণিকদিগের নিকট পাঁচটারা হারে বিক্রয় করিয়া একলক্ষ বিশ হাজার টাকা লাভ করিতে পারিবেন।
বণিকসভার বেরেলস্ট এবং সাইক সাহেব এই আরমানিয়ান বণিকের লবন হস্তগত করিবার নিমিত্ত বিশেষ চেষ্টা করিতে লাগিলেন. অবশেষে তাংহাকে দুইটাকা হারে প্রত্যেক মণের মূল্য দিতে স্বীকার করিলেন। কিন্তু আরাটুন সাহেবে তাঁহার লবন দুই টাকা হারেও বিক্রয় করিতে সম্মত হইলেন না। তকন ইংরাজগণ বল পূর্বক তাঁহার গোলা ভাঙিয়া সমুদয় লবণ হস্তগত করিবেন বলিয়া কৃতসংকল্প হইলেন। বাণিজ্যে লাভ হইলেই হইল। টাকা সঞ্চয় করাই তাঁহাদিগের একমাত্র খ্রিষ্টীয়ধর্ম। বণিকসভার অধ্যক্ষ বেরেলস্ট এবং সাইক সাহেব আরাটুন সাহেবের গোলা ভাঙিয়া, তাঁহার তাঁহার দিনাজপুরের গোলার লবণ হস্তগত করিবার নিমিত্ত লেপ্টেন্যান্ট ডবসনকে কয়েকজন গোরা ও সিপাহীর সহিত দিনাজপুর প্রেরণ করিলেন। ডবসন সাহেব দিনাজপুর পৌঁছিয়া আরাটুন সাহেবের লবণের গোলা ভাঙিয়া, তাঁহার সমুদয় লবণ হস্তগত করিলেন। (চন্ডীচরণ সেনের মহারাজা নন্দকুমার - শতবত্সর পূর্বের বঙ্গের সামাজিক অবস্থা থেকে)
বাঙলা থেকে যে বিপুল পরিমান সম্পদ লুঠে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সমগ্র পলাশির শতাব্দটি থেকে, তাকে মোদ্দাভাবে চার ভাগে ভাগ করা যায় – ১। ঘুষের অর্থ, হিরে, জহরত, মণিমুক্তো নানান প্রক্রিয়ায় দেশে পাঠানো, ২। ইওরোপ-ইংলন্ডে প্রায় বিনামূল্যে বাঙলার রপ্তানি পণ্য আর সোনা-রূপো পাঠানো, ৩। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ওপর বিল অব এক্সচেঞ্জ, ৪। বাণিজ্যে অন্যান্য বিদেশি কোম্পানির ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পদাঙ্ক অনুসরণ। ইংরেজ ব্যবসায়ীরা তেল, নুন, আফিম, আদা, চিনি, সুপারি, তামাক, ঘি, মাছ, শুঁটকি, খড়, চট, বাঁশ, কাঠেরমত তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যবসায় একচেটিয়া দখল কায়েম করল। এই দ্রব্যগুলোর একচেটিয়া ব্যবসা সাধারণের জীবনে প্রভাব ফেলবে, এ তথ্য জানতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। দেশের মানুষের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠল। পলাশির পর সত্তর বছর ধরে বাঙলার বাণিজ্যে এত কমদামি মাল নিয়ে কারবার বাঙলার মানুষ এর আগে দেখেনি।
ক্রমে ক্রমে ইংরেজরা ধান চালের বাণিজ্যে হস্তক্ষেপ করতে লাগল। মির কাশেমের সময় বাঙলা জুড়ে অন্ততঃ পাঁচশো ইংরেজ কুঠি গজিয়ে উঠেছে। ইংরেজদের সহায়তায় বাঙালি গোমস্তা, বেনিয়ান আর দেওয়ানরা কোম্পানির দস্তক দেখিয়ে অবাধ মুক্ত বাণিজ্য চালাচ্ছে। ইংরেজদের লুঠতরাজের নেতৃত্বে যোগ্য সঙ্গত প্রদান করছে। শুধু ইংলন্ডেই নয়, বাঙলায় ইংরেজরা মুক্ত বাণিজ্যের দাবি করল। অবাধ, মুক্ত বাণিজ্য বলতে কোম্পানির সহায়তায় সেনাবহর সঙ্গে নিয়ে ব্যবসায়ী আর ছোট উত্পাদক রায়তদের কাছ থেকে দাদনের নামে সিকি দামে, অথবা পণ্যদ্রব্য লুঠ করে, ৫০০ শতাংশ দামে সেই দ্রব্য আবার রায়তদের বিক্রি করত। এই ব্যবসায় বাঙালি আর ইংরেজরা কত অর্থ লুঠ করেছে তার লেখাজোখা নেই।
১৭৬২র মে মাসে মির কাশেম ভ্যন্সিস্টার্টকে লিখছেন, এই হল আপনাদের ভদ্রলোকেদের ব্যবহার। আমার দেশে সর্বত্র তারা উপদ্রব করে, জনগণের ওপর লুঠতরাজ চালায়, আমার কর্মচারীদের অপমান জখম করে, প্রত্যেক গ্রাম পরগণা, ফ্যাক্টরিতে তারা লবন, সুপারি, ঘি, চাল, খড়, বাঁশ, মাছ, চট, আদা, চিনি, তামাক, আফিম, ও অন্যান্য জিনিষ কেনা বেচা করে। আমি আরও অনেক বস্তুর নাম করতে পারি অপ্রয়োজনে বিরত হলাম। তারা বলপ্রয়োগ করে কৃষক বণিকদের পণ্য একচতুর্থাংশ দামে ছিনিয়ে নেয়, জবরদস্তি করে কৃষককে এক টাকার জিনিষ পাঁচ টাকায় কিনতে বাধ্য করে। আবার পাঁচটি টাকার জন্য তারা এমন এক মানুষকে অপমান ও আটক করে, যে একশ টাকা ভূমি রাজস্ব দেয়। আমার কর্মচারীকে কর্তৃত্ব করতে দেয় না। প্রত্যেক শুল্ক থেকে বঞ্চিত হওয়ায় আমার রাজস্ব ক্ষতির পরিমান দাঁড়াচ্ছে পঁচিশ লক্ষ টাকা।(পালাশির ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ - পালাশির ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ, রজতকান্ত রায়) মির কাশেম দেখলেন দেশিয় বা ইংরেজ, কোনও ব্যবসায়ীই সরকারি মাশুল দিচ্ছেনা। ঘোষণা করলেন ব্যবসায়ীদের আর শুল্ক দিতে হবে না। দস্তকও দেখাতে হবে না।
No comments:
Post a Comment