{এই মুখবন্ধটা শুধুই তাত্ত্বিক কচকচানি - এড়িয়ে যাবেন}
পলাশী পূর্ব বাংলার বাণিজ্য প্রচেষ্টা বর্ণনার ঢোকার আগে শুরুতেই কয়েকটা অপ্রিয় তত্ত্ব তথ্য বলে নেওয়া দরকার, নাহলে পরের দিকে ভুলবোঝাবুঝির যথেষ্ট সম্ভাবনা থেকে যেতে পারে।।
এই মুখবন্ধটা লিখতে লিখতে(রাত দেড়টা নাগাদ) ইনবক্সে একজন ফেবুতে চেনা(মুখাবৃত) বন্ধু আমাদের লেখালিখি ইত্যাদি দেখে খুব বেশি কিছু বুঝতে না পেরে গোটাগুটি বুঝভুম্বুল হয়ে আমাদের কাজকর্ম, তত্ত্ব, দিশা, উদ্দেশ্য ইত্যাদি কিছুই সরাসরি না জানতে পেরে খুব জোর দিয়ে জানালেন, কারো কারো ধারণা আমরা নাকি “রাজ্য সরকার ঘনিষ্ট এক চূড়ান্ত বাম বা অতি বাম”(উনি ব্যক্তি মানুষ বলেছেন, আমরা সেটা গৌরবার্থে সংগঠন ধরে নিচ্ছি – ধরেই নিচ্ছি তিনি কারোর হয়ে এই কথাগুলি আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছেন না)। আস্যর্থ, আমরা চরমতম বাম অথচ মমতা সরকারের দাক্ষিণ্যওয়ালা সংগঠন। উনি এটা বলে আমাদের অবস্থা স্পষ্ট করার সুযোগ যে করে দিলেন তার জন্য ধন্যবাদ।
স্পষ্টভাবে বলে নেওয়া দরকার ধ্রুপদী বামপন্থী অর্থনীতি বলতে যা বোঝায়, আমরা আমাদের সংগঠন তার থেকে সম্পূর্ণ উল্টো অবস্থানে বিচরণ করছি – তাত্ত্বিক ও তাথ্যিকভাবেও, সেই তত্ত্ব আমরা স্বীকার করি না, আমরা সম্পূর্ণ বিরোধ করি। ব্রিটিশ পূর্ব বাংলায় রাষ্ট্রীয়ভাবে সরকারি হস্তক্ষেপের সুযোগ ছিল খুবই কম, মানে সমাজ তা করতে দেয় নি। সরকারকে গ্রামসমাজ রাজস্ব দিয়েছে ঠিকই, তার সঙ্গে সঙ্গে তাকে সমাজে সাধারণভাবে দখলদারি করতে বাধা দিয়েছে। ফলে বিকাশের জন্য যা করার দরকার ছিল, সেটা সমাজ, কারিগর গোষ্ঠী ইত্যাদিরা নিজেরাই করে নিয়েছিল। কিছু বড় ব্যবস্থা বিকাশ করা ছাড়া প্রায় সব কিছুই সামাজিক/ব্যক্তি উদ্যম। তবে আজকের মতো কিন্তু বড় পুঁজি(জগৎশেঠ পরিবার) শহর আর সরকার নির্ভর হয়ে দেশে দেশে বেড়ে উঠেছিল।
কিন্তু কারিগরী জ্ঞান, প্রযুক্তি, বাজার, প্রযুক্তি-পণ্য বিকাশ সবই হয় ব্যক্তিগত না হয় সামাজিক উদ্যম ছিল। ফলে আমাদের কাজের সঙ্গে বিগত একশ বছর ধরে বিকশিত রাষ্ট্রীয় মালিকানার কোন যোগ নেই। আমরা আমাদের পূর্বজ কারিগরদের মত মনে করি জাতি রাষ্ট্রের দখলদারি ছোটলোকেদের ব্যবসায় খুব ক্ষতিকপ্র এবং অবাঞ্ছিত, তাহলে সরকার আপনাকে সাহায্যের বদলে তার চাহিদাতা চাপিয়ে দেবে, দেবেই। ফলে আমরা বামপন্থী নই, মার্ক্সপন্থী নই – এবং মার্ক্স গাঁইয়াদের সহ্য করতে পারতেন না, আর ভারত ভাঙ্গায় কোম্পানিকে মৃদু বকেও বাংলা তথা ভারতের উতপাদন ব্যবস্থা ভাঙ্গার কাজকর্ম বিষয়ে বেশ সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন। ফলে আমরা কোনভাবেই মার্ক্সপন্থী নই, মাওপন্থী নই – আমরা ছোটলোক পন্থী, আমরা বাংলাপন্থী। হ্যাঁ আমরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের সেজ বিরোধী, সরাসরি বিদেশি লগ্নী বিরোধী, গ্রামকে সমর্থনের পক্ষের অধিকাংশ নীতি সমর্থন করি। এতে যদি কেউ আমাদের তিনু আর সরকারের দাক্ষিণ্যওয়ালা সংগঠন বলে সেটা তার মাথাব্যথা, আমাদের নয়।
---
---
এবারে আসল তর্কের ঢুকি। বাংলা/ভারতের(আপাতত বাংলা বলেই বলব) উৎপাদন ব্যবস্থার কতগুলো জোরের জায়গা ছিল আছে থাকবে – সে আলোচনাটা বাণিজ্য বিষয়ে ঢোকার আগে করে নেওয়া ভাল, তাহলে বোঝা যাবে বাংলার সঙ্গে পশ্চিমের উৎপাদন ব্যবস্থার পার্থক্য কোথায়। বাংলায় যে উৎপাদন ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল কয়েক হাজার বছরের টানাপোড়েনে, সেটা আদতে বিশ্ব রক্ষা আর সাম্য রক্ষার আন্দোলন। হাজার হাজার উৎপাদক, হাজার হাজার বিক্রেতা। ফলে কারোর হাতেই অতিরিক্ত লাভের অর্থ জমে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। লাভের গুড় ছড়িয়ে পড়ত সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে। বড় কারখানা তৈরি করার কোন সুযোগ ছিল না। সুযোগ ছিল না কয়েক জন কারিগরের কারখানা কিনে নিয়ে একটা বড় কারখানা করে সেখানে একা বা কয়েকজন মালিক হয়ে গোটা বিক্রির লাভ নিজের পকেটে ঢোকানোর। তাই যখন ১৬১০/১০১৭ সালে ইওরোপে বাংলার কার্পাস কপড় যাচ্ছে ১০ লক্ষ গজ আর ১৬৭০/১০৭৭ সালে ইওরোপে যাচ্ছে ১০ কোটি গজ, এই বাড়তি উৎপাদন ভারতের সমাজ সামলাচ্ছে কিন্তু ইওরোপের মত বড় কারখানা না করেই, বিপুল তাঁত, কাটনি, রঞ্জক এবং চাষী তৈরি করে। ফলে যে লাভটা এল তা হয়ত কিছু মানুষের হাতে একটু বেশি গেল ঠিকই, কিন্তু অধিকাংশই ছড়িয়ে গেল সমাজের বিভিন্ন উৎপাদকের স্তরের মধ্যে।
বাংলা যে বাণিজ্যে বহুকাল ধরে উদ্বৃত্ত এ কথা পাল আমল থেকে, হয়তবা তার আগের সময় থেকেই নিদারুণ বাস্তব সত্য। দুর্ভাগ্যের কথা সে সত্য স্বীকার করতে চান না নানান মহল। সুলতানি আমলে সেই বৃদ্ধি চরম শিখরে উঠতে থাকে সরাসরি সুলতানদের কারিগর এবং কৃষকদের পৃষ্ঠপোষকতা করার মাধ্যমে। শহরে শহরে কারখানা গজিয়ে উঠল রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ্য মদতে। কিছু হাতে গোনা কারিগর রাষ্ট্রের, এবং রাষ্ট্রের মদতে কাজ করলেও, যে ব্যবস্থা তৈরি হয়, তাতে কারিগরেরা তাদের অতিরিক্ত উৎপাদন নিজের বাজারে বিক্রি করে বেশি থাকলে, প্রদেশ এবং বিদেশের বাজারে পাঠাতেন। সুলতানি/মুঘল/নবাবী আমলের কারখানার সঙ্গে আজকের পশ্চিমি প্রযুক্তির কারখানার আকাশ পাতাল তফাত। শুধু বিদেশের বাজারের দিকে তাকিয়ে কোন কারিগরই উৎপাদন করতেন না, কোন কারখানা/আড়ংও সে কাজ করত না।
বহু মানুষ বহুভাবে বাংলার বাণিজ্য সমৃদ্ধির কারণ বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন রিকার্ডো বর্ণিত অর্থনীতির সূত্রগুলি ধরে, যার একটাও সূত্র বাংলার (এবং স্বাভাবিক ভারতের নানান প্রান্তের) অর্থনীতির বিকাশের সঙ্গে কোন ভাবেই প্রযোজ্য ছিল না। আসলে লুঠেরা, খুনি, দখলদার কেন্দ্রিভূত প্রযুক্তিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার তত্ত্ব দিয়ে কোনভাবেই বিকেন্দ্রিত, শুধু লাভের দিকে নজর না দেওয়া দক্ষতা, প্রযুক্তি হাতে নিয়ে, মূলত নিজের বাজারের জন্য কাজ করা কারিগরদের উৎপাদন ব্যবস্থার দর্শনটাই, ভালবাসা, জ্ঞান সব কিছুই আলাদা রকমের। দীপঙ্কর দে এই তত্ত্ব নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। তিনিই যোগ্য মানুষ যিনি এই ব্যবস্থার মোদ্দা কথাগুলি আমাদের জানাতে শোনাতে আর বোঝাতে পারেন। আর সব প্রখ্যাতদের তৈরি করা শিল্পোন্নতির তথ তত্ত্ব সব বানানো এবং তার ভিত্তি অন্তত বাংলায় নেই।
(ক্রমশঃ)
(ক্রমশঃ)
No comments:
Post a Comment