মুর্শিদকুলি খাঁ যখন বাংলায় এলেন তখন রাজমহল আর ঢাকায় দুটো টাঁকশাল। ১৭০৮/১১১৬য় রাজমহলের টাঁকশালটা তিনি মুর্শিদাবাদে আনলেন।
সোনার টাকা মোহর নামে পরিচিত। সোনার মোহরের সঙ্গে রূপোর টাকার বিনইময় মূল্য ছিল চৌদ্দ থেকে ষোল সিক্কা(সেই জন্য কি আমি অন্তত আমার বাল্যকালে কথ্য ভাষায় ষোল সিকি কথাটা শুনতাম)। সোনার টাকা ছিল মূলত রাজস্ব, উপঢৌকন, উপহার বা সঞ্চয়ের জন্য। রূপোর টাকা(যেখান থেকে রূপিয়া) প্রায় ১০০ ভাগ খাঁটি। সিক্কা টাকা বাজারে সরকারের ছাপমারা টাকা। তামার পয়সার নাম দাম। এক রূপোর টাকা সমান চল্লিশ দাম। শতাব্দের শুরুতে তামার দামকে প্রতিস্থাপিত করল ব্যপ্তভাবে কড়ি, বলা দরকার কড়ি ছিলই বহুকাল থেকেই, কিন্তু তামার মুদ্রা এই প্রথম বাজার থেকে হঠে গেল। বাংলাকে যেহেতু তামা সরবরাহের জন্য ডাচেদের ওপর নির্ভর করতে হত, তাই কড়ি হল বৈধ খুচরো মুদ্রা। এক টাকা সমান ৩২ পণ কড়ি(২০ গণ্ডায় এক পণ)।
বাংলায় ব্যাঙ্কিংএ হরিশ চন্দ্র সিংহ লিখছেন, বাংলা বাজারে সারা ভারত থেকে বহুরকমের মুদ্রা আসত। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর সারা ভারতে অনেকগুলো স্বাধীন রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল। তারা নিজেরাই মুদ্রা চালু করেছিলেন। সেই কয়েকশ ধরণের মুদ্রা নানান মাপের নানান দামের নানান ওজনের। মুঘলদের টাকার আকৃতি আর ওজনও ছোট হয়ে গেল। বাংলা ছাড়া দক্ষিণ আর পশ্চিম ভারতে ইংরেজ, ফরাসি, ওলান্দাজেরা নিজের নিজের টাকা ছাপাত। বাংলার বাজারে আর্কটের প্যাগোডা, ইংরেজ ফরাসি আর ওলান্দাজদের আর্কট, সুরাট বোম্বাই, কাশী আর অযোধ্যার টাকাও আসত। বাংলা বাজারে সে সময় ভিন্ন আকৃতি আর ওজনের বত্রিশ রকমের মুদ্রার খবর পাওয়া যায়। শুধু আন্তর্জাতিক ব্যবসাই নয় আন্তঃরাজ্য ব্যবসার লাভের গুড় দেখাগিয়েছে বাংলার পক্ষেই থাকত। ফলে সক্কলে বাংলার সঙ্গে ব্যবসা করতে চায় – তাই প্রচুর মুদ্রা। বাংলার কেন্দ্রিয় ব্যাঙ্কিং পরিবার জগতশেঠেরা এই বিনিময় হার ঠিক করত, এছাড়াও দেশ জোড়া মুঘলদের বিভিন্ন টাঁকশালের মুদ্রাও অভিন্ন ছিল না। ঢাকা, পাটনা, কটকের টাকা মুর্শিদাবাদের টাকার সমান বিনিময় হার ছিল। বাংলায় প্রচুর পোদ্দার, স্রফ মুদ্রা বিনিময় ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল। জগৎশেঠ পরিবারের সঙ্গে তাদের ব্যবসা ছিল। যারা তাদের বিরোধিতা করত বা সমান্তরাল আর্থিক লেন্দেন চালাত তারা বাজার থেকেই বার হয়ে যেত।
বাংলায় চালু ছিল চালানি টাকা। কোন কাল্পনিক টাকা নয়, সব ধরণের টাকার বিনিময় ঠিক হত এর মাধ্যমে – এই টাকার কোন ক্ষয় নেই, পরিবর্তন নেই। এর আগেই বলেছি তিন বছর অন্তর টাকা নতুন করে ছাপাবার জন্য টাঁকশালে আসত। সেখান থেকে বেরোবার পর এক বছর সে টাকা বাজারে পূর্ণদ্যোমে চলত। দ্বিতীয় তৃতীয় বছরে ক্ষয়ের জন্য দাম কমতে থাকত তার। তখন এর নাম হত সোনাত বা সোনার মত। সিক্কা টাকা এক বছর পর তিন আর দু বছর পর পাঁচ শতাংশ দাম কমত।
আরেকভাবে উদাহরণ দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করা যাক। সিক্কা টাকার সঙ্গে চালানি টাকার বিনিময়ের হার হল ১০০ সিক্ষা টাকা সমান ১১২.৫ চালানি টাকা। এটা সরকারি হার, খোলা বাজারের দর ১১৮ চালানি টাকা। ক্ষয় হোক আর নাই হোক সিক্কা দ্বিতীয় তৃতীয় বছর সোনাত হলে সেই সোনাতের সঙ্গে চালানি টাকার বিনময় হল ১০০ সোনাত সমান ১১১ চালানি টাকা।
সরকারিভাবে সিক্কা আর সোনাতের মধ্যে পার্থক্য রাখা হয়েছিল। মুখ্য উদ্দেশ্য হল সিক্কার শ্রেষ্ঠত্ব এবং তার একমাত্র বৈধতা বজায় রাখা। সেই জন্য তিন বছর পরে সোনাতকে সিক্ষায় রূপান্তরিত করার উদ্দেশ্যটাই তাই। নাহলে সোনাতই বাজারের প্রধান মুদ্রা হত। দামে কম বলে বাংলার ব্যসায়ীরা তৃতীয় বছরে পোদ্দার আর স্রফেদের(যারা টাকার মূল্য ঠিক করত) কাছে সোনাত নিয়ে যেত আর তারা টাঁকশালে সেই সোনাত নিয়ে যেত সিক্কা করার জন্য। তাতে টাঁকশালের আয়ও হয়। দুশতাংশ বাটা দিয়ে তারা সোনাতের সঙ্গে সিক্কা বদল করত। কারণ তিন বছর পরে মুদ্রার আর কোন মূল্য থাকত না, তার ধাতু মুল্যেই তার দাম ঠিক হত। চালানির সঙ্গে ইংরেজদের আর্কট মুদ্রার বিনিময় ছিল ১০০ আর্কট সমান ১০৯ চালানি টাকা।
No comments:
Post a Comment