আবার ফিরি নবাবি আর্থব্যবস্থায়। চালানি টাকা ও মাদ্রাজ টাকার মধ্যে বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় ব্রিটিশ কোম্পানির বেশ ক্ষতি হচ্ছিল। বাংলাদেশে রূপো এনে জগতশেঠেদের কাছে বিক্রি করতে হত। ডলার রূপোর ২৪০ সিক্কা ওজনের জন্য তারা পেত ২০১-২০৬.৫ চালানি টাকা। অথচ মাদ্রাজে তারা পেত ২১৮ চালানি টাকা। এবং বাংলায় টাঁকশালে বাটা দিয়ে ছাপাতে পারলে তারা পেতে পারত ২৩৩ চালানি টাকা। কিন্তু জগতশেঠেদের বাধায় তারা সে লাভ করতে পারত না।
ফলে ইংরেজরা সুজার সময় রূপো আনা কমিয়ে দিয়ে বেশি করে মাদ্রাজি টাকা বাংলা বাজারে আনতে থাকে। তাতে টাঁকশালের রাজস্ব কমে গেল এবং রূপোর অভাবে রূপোর সিক্কা টাকা তৈরি হওয়ার অসুবিধে দেখা দিল। ১৭৩১/১১৩৮এ সুজা বাংলার বাইরের সমস্ত বিদেশি টাকা অবৈধ ঘোষণা করলেন। শুধু তাদের ধাতুগত মূল্য স্বীকার করবেন কথা হল। আর চালানি টাকা আর আর্কট টাকার মধ্যে বিনিময় বাটা সুজাউদ্দিনের আগে ছিল ৩.৫ – ৪.৫ শতাংশ(যদিও তাদের ধাতুগত মূল্যে পার্থক্য ছিল ০.৫৬ শতাংশ)। তিনি তা বাড়িয়ে ৭.৫ শতাংশ করে দিলেন। ১৭৩৭এ উপদেওয়ান আলমচাঁদকে ইংরেজদের গত পাঁচ বছরে বাংলায় আনা সোনা রূপোর হিসেব দাখিল করতে বললেন। ইংরেজরা এই হিসেব দাখিল করতে বাধ্য হয়েছিল। নতুন বিনিময়ের হারে কর্পোরেট কোম্পানিগুলো বিপদে পড়ল। বাংলার ব্যবসায়ী আর মহাজনেরা জগতশেঠেদের অঙ্গুলি হেলনে মাদ্রাজ/আর্কট টাকা নিতে না চাওয়ায়, এ টাকার দাম আরও পড়ে গেল। ফলে ইংরেজদের আরও বেশি করে রূপো আনতে হল। নতুন বিনিময় হারে মাদ্রাজ টাকা এনে লাভ নেই।
জন কোম্পানির বাংলাদেশে মাল কিনতে যে সোনা রূপো নিয়ে আসত, সেটা এদেশিয় টাকায় রূপান্তরিত করার তিনিটে পথ ছিল বলছেন কীর্তিনারায়ণ চৌধুরী, দ্য ট্রেডিং ওয়ার্ল্ড অব এশিয়া এন্ড দ্য ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বইতে। প্রথমত সোনা রূপো এদেশের টাঁকশালে দিয়ে টাকা নেওয়া। এটার প্রধান অসুবিধে হল এই কাজে বেশ সময় লাগে – ফলে প্রয়োজনমত টাকার যোগান পাওয়ায় অসুবিধে হয়। আর নবাবদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হলে গোটা দামি ধাতুই নবাবের কোষাগারে চলে যায়। এদেশি বণিকেরা টাঁকশাল কর দিয়ে টাকা ছাপানোর অধিকার ভোগ করত, কিন্তু সে অধিকার ছিল না বিদেশিদের। পরের অদ্ধতি হল সোনা রূপো এনে জগতশেঠেদের গদিতে দিয়েতাদের নির্ধারিত দামে টাকা সংগ্রহ। এটা তাড়াতাড়ি ঘটত। কিন্তু বিনিময় হার ব্যাঙ্কারদের হাতে থাকায় ইওরোপিয়রা ক্ষতিগ্রিস্ত হত। তৃতীয় পদ্ধতি হল বাংলার বাইরে তাদের নিয়ন্ত্রিত টাঁকশালের টাকা এনে বাংলায় ব্যবহার – যা তারা সুজার সময় করেছিল রূপো আনা কমিয়ে। কিন্তু চালানি টাকা আর বাংলার বাইরের টাকার বিনিময়ের হাত নির্ধারিত করত ব্যাঙ্কারেরা। সুজার পরে আবার দ্বৈত পদ্ধতি শুরু হয়।
বাংলার ব্যঙ্কিং ব্যবস্থায় হুজুরুমল, জনার্দন শেঠ, বানারসী শেঠ, রামকিষেণ শেঠ, আনন্দিরাম ও শ্রীকৃষ্ণ প্রভৃতি ব্যাঙ্কারেরা ছিল, কিন্তু এদের মধ্যমণি ছিল জগতশেঠ। এদের কাজ ছিল টাকার বিনিময় করা, হুণ্ডিকাটা, আমানত নেওয়া, দুদে টাকা ধার দেওয়া, টাকার বিনিময় করা এবং বিভিন্ন ব্যবসায় লিপ্ত থাকা। এদের রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল অভূতপুর্ব যা এর আগে কিছুটা আলোচনা করা গিয়েছে।
No comments:
Post a Comment