বোর্ড অব ট্রেডএর চুক্তিতে ক্ষুব্ধ কোম্পানির ডিরেক্টর সভা কর্মচারীদের দেশে ফেরার পর কয়েকজনের নামে মামলা দায়ের করে – যাদের মধ্যে প্রভাবশালী হেস্টিংসও ছিলেন। ভারতে কোম্পানির আমলাদের ব্যবসায় বাস্তবিক যে ইতরবিশেষ ঘটেনি তার প্রমাণ ব্যবসায়ীদের থেকে হেস্টিংসের বেনিয়ান কান্তবাবু, আরও পরে রামমোহন, দ্বারকানাথদেরমত মানুষদের অবাধে বেড়ে চলা দস্তুরি নেওয়ার প্রবণতা থেকে। দেশিয়দের খুঁটি ইংরেজ বড় আমলারা, যাঁরা বাঙালি গোমস্তা, বেনিয়ান, দালাল, সেরেস্তাদার আর পাইকারদের মাধ্যমে বাঙলায় অবৈধ ব্যক্তিগত ব্যবসা করত। পণ্য কেনার সময় বাঙালি কর্মচারীরা দস্তুরি নিত, প্রতি টাকায় পাঁচ গণ্ডা থেকে ৩০ গণ্ডা দরে। কোম্পানি কর্মচারীদের লুঠের কাজে সরাসরি সাহায্য করত বাঙালি গোমস্তা, বেনিয়ান আর দেওয়ানরা দুহাত ভরে। এরাই বেনিয়ান রামমোহন রায় অথবা ব্যবসায়ী দ্বারকানাথ ঠাকুরের পূর্বসূরী। ইংরেজেদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায়রত দেশিয় ব্যবসায়ী আর রায়তদের অসীম দুর্দশায় ইংরেজ কর্মচারীরা আর ইংরেজমুখী বাঙালি কর্মচারী, দালালেরা রোজগার করতেন। বাঙলায় মুক্তিসূর্য রামমোহন-দ্বারকানাথসহ কলকাতার অমিততেজেরা, অথবা রেনেসাঁজাত খ্যাত অখ্যাত নানান ব্যক্তিত্ব কোথা থেকে তাদের ব্যবসা শুরুর অর্থ অথবা নিজেদের ঠাটবাট বজায় রাখার সম্পদ পেতেন, তার রহস্য বাঙালি গোমস্তা, বেনিয়ান, দালাল, সেরেস্তাদার আর পাইকারদের অবৈধ দস্তুরির রোজগার আর ব্রিটিশদের সঙ্গে লুঠের অবৈধ ব্যবসার সাথী হওয়া থেকে পরিস্কার। মুর্শিদাবাদের দরবারে রেসিডেন্ট কমিশনার সাইক্স সোরা, রেশম আর কাঠের ব্যবসার সেলামি থেকে একা রোজগার করেছেন বার থেকে তের লক্ষ টাকা, তার দেওয়ান অথবা বেনিয়ান কত রোজগার করেছে তা অনুমানযোগ্য।
দ্বারকানাথের উত্তরসূরী ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর্দার বাবার সময়ে ঘুষের কথা বলতে গিয়ে বলছেন ৩৫ টাকা মাইনের কর্মচারী, ব্রিটিশ বড়বাবুকে মাসে ৫০০ টাকা করে ঘুষ দিতেন। আমরা যেন মনেরাখি ১৮২০ সালে মাসে দুটাকা রোজগার করে ঈশ্বরচন্দ্রের পিতা ঠাকুরদাস নিজেকে স্বচ্ছল ভেবে বাড়িতে অর্থ পাঠাবার উদ্যোগ করছেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে এ ধরণের ছোটখাট ঘুষের বিষয়তো আলোচনাই হয় নি। যেসব বিষয় আলোচনা হয়েছে তা শুধুই বড় বড় পরিমানের ঘুষের পরিমান।
ভারত দেশের রীতনীতি বিষয়ে অজ্ঞ ইওরোপিয়রা বাঙালি বেনিয়ান, গোমস্তা, মুন্সি আর সরকারদের মাধ্যমে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতেন। বাঙলায় নতুন ইওরোপিয় পদার্পণ করলেই তাদের দালালি করার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত এদেশিয়দের মধ্যে। এদের অধিকাংশই ছিলেন চিরাচরিত ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মানুষ – দাদনি ব্যবসায়ী। পলাশির পর ইওরোপিয়দের প্রধান ব্যবসায়ী কর্মচারী দালালদের বেনিয়ান নামে ডাকা শুরু হয়। একজন ইওরোপিয়র দরবারে বেনিয়ান ছাড়াও ছিলেন দোভাষী, দালাল, হিসাবরক্ষক, প্রধান অমাত্য (সেক্রেটারি), পুঁজির যোগানদার আর খাজাঞ্চি। নানান বৈধ অবৈধ ব্যবসায় এদেশিয়রা মাহির ছিল। ইওরোপিয়রা তাদের নাম ধার দিতেন। ব্যবসায় মূল লাভ্যাংশটা পেতেন। একজন বেনিয়ান আবার অনেকসময় একের বেশি ইওরোপিয় ব্যক্তি অথবা প্রাইভেট এজেন্সির বেনিয়ানরূপে কাজ করতেন।
অসীম রায় নবাববাঁদী উপন্যাসে সদ্য ভারতে পা রাখা প্রভাবশালী এক ইংরেজ রাজপুরুষের রাইটার ভ্রাতুষ্পুত্রকে, বানিয়ান গোকুল মুখার্জীর দেওয়া মাইনের যে ফর্দ উল্লেখ করেছেন তা উল্লেখ করা গেল-
পালকিতে দুলতে দুলতে গোকুলের দেওয়া লম্বা কাগজের ফালিটা চোখের সামনে মেলে ধরে
খানসামা ১২ টাকা
বাটলার ৮
খিদমতগার ৬
পাচক ১৫
পাচকদের যোগানদার ৬
মশালচী ৩
পিয়ন ও হরকরা ৪
চুলফেলা নাপিত ২
৩টাকা হিসেবে ৬ জন বেয়ারা ১৮
হেড বেয়ারা ৫
লোকজনদের বাড়িভাড়া ২৬
দাড়িফেলা নাপিত ২
হুঁকোবরদার ৫
নালি সরদার ৪
সর্দারের অনুচর ৩
সহিস ৩
ধোবি ২
ইস্ত্রিওয়ালা ২
দর্জি ৩
মোট ১২৯ টাকা
মাই গড এরপর গোকুলের সুদ। এ ছাড়া কাপড়-চোপড়, পালকি, বগি, বজরা, বাড়ি। তার ওপর টাকা জমানো। নাঃ প্রাইভেট ট্রেড ছাড়া কোনও উপায় নেই।
গ্রামীণেরা তখন ব্রিটিশ সৈন্যের সঙ্গে সম্মুখ সমরে লড়ছেন। সে সময় কলকাতার মধ্য-উচ্চবিত্ত শ্রেণী নানান প্রকারের ব্যবসায় ব্রিটিশ শক্তিকে সরাসরি সাহায্য করছেন। দেশের শিল্প-ব্যবসা পরিকাঠামো ধংসে ব্রিটিশদের সহায়তা দিচ্ছেন। সাম্রাজ্যের লাভের গুড়ের ছোট্টঅংশিদার হয়ে উঠেছেন। রাজভক্তির ছায়ায় দাঁড়িয়ে এই মহাতেজেরা কখোনো সরাসরি (রামমোহন, দ্বারকানাথসহ অন্যান্য নিমক মহলের দেওয়ান বানিয়ান, জমিদার), আবার কখোনো পরোক্ষভাবেই (বিদ্যাসাগর – গ্রাম বাঙলার একলাখ পাঠশালা ধংস করে শহুরেদের সরকারি সাহায্যে পাঠদানের সরকারি নীতি প্রণয়নের উদ্যোক্তা) দেশের পরিকাঠামে ধংস করতে, স্বাধীণতাকামী সরাসরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা গ্রামীণ জনগণকে খুন করতে, উচ্চশিরদাঁড়া বেঁকিয়ে দিতে ব্রিটিশদের সহায়তা করেছেন। রাজানুগত্য এমনস্তরে পৌঁছয়, লবন মহলের লুঠতরাজে প্রতিবাদী মালঙ্গীরা স্বাধীণতা সংগ্রাম করলে, পালকি বেহারারা কাজ বন্ধ করে দিলে, আফিম চাষীরা সরাসরি লড়াই করলেও, তিতুমীর প্রাণ দিলেও তাদের পাশে দাঁড়াবার জন্য একজনও নবজীবনের অগ্রদূতেদের দেখা পাওয়া যায়না, ব্রিটিশ বিরোধিতায় কারোর গলা একবিন্দুও ওঠেনা। শুধুমাত্র নীল সংগ্রামে এঁরা নড়ে চড়ে বসেছিলেন। জমিদার, ব্রাহ্মণ আর শহুরেদের গায়ে হাত পড়েছিল তাই। তবুও আজও সকলেই বাঙলার নবজীবনের অগ্রদূত।
No comments:
Post a Comment