শের শাহর আমলে জমি জরিপ ও খরাজ ব্যবস্থা
শের শাহর আমলে কিসমতিগল্লা(ব্রিটিশরা লিখবে কিসমত-ই-গল্লা। অন্তত বাংলায় বড়
আরবি বা ফারসি শব্দ ব্রিটিশদের অনুসরণে ভেঙ্গে লেখার প্রথা বন্ধ হোক। এটা
ঔপনিবেশিক পদ্ধতি। ইওরোপিয়রা বড় সমাসবদ্ধ শব্দ বুঝতে পারত না বলে ভেঙ্গে লেখার চল
করেছে। একগজি(মুজতাবা আলি উবাচ) সংস্কৃত বা জার্মান সমাসবদ্ধ পদ যখন আমরা ভেঙ্গে
লিখি না, তাহলে বন্ধু আরবি ফারসি বড় সমাসবদ্ধ পদ অর্বাচীন অবুঝ ইওরোপিয়দের মত
ভেঙ্গে লেখার কোন যুক্তি দেখি না। এই যুক্তি দেখিয়েছিলেন মরহুম মুসতাফা সিরাজ মশাই)
অর্থাৎ উৎপন্ন ফসলের একতৃতীয়াংশ খাজনা হিসেবে আদায়ের যে নিয়ম চালু ছিল তার সঙ্গে
তিনি চালু করলেন জরিপ প্রথায় আদায়। জমি বন্দোবস্তের সময় চাষীদের খাজনা দেওয়ার
প্রথা বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হত। অর্থাৎ পুরোনো কিসমতিগল্লা না জমি জরিপ করে
ফসলের উৎপন্ন পরিমান ঠিক করা হত, তারপরে তার ১/৩ অংশ নেওয়া হত। চাষীরা তাদের
সুবিধে মত ইচ্ছে প্রকাশ করত। তখন জমির পরিমান, কি কি ফসল কৃষক চাষ করবে ইত্যাদি
ঠিক হত।
এবারে তিনি তার কর্মচারীদের জানালেন তিনি জানেন যে রাজস্ব কর্মচারীরা চাষীদের
থেকে একটু বেশি অর্থ নিয়েই থাকে। তিনি দুটি ব্যবস্থাতেই তাদের প্রাপ্য আদায় ঠিক
করে দিলেন কারণ এই প্রাপ্য চাষীদেরই দিতে হত।
পাট্টা ও কাবুলিয়তের মাধ্যমে তিনি বিলিবন্দোবস্ত সরকার আর প্রজাদের মধ্যে ঠিক
করলেন। জমির দলিল করে(পাট্টা) চাষীদের বিস্তারিত জানালেন, রাষ্ট্র কোন জমি, কত
পরিমান, কত খাজনায় তার সঙ্গে বন্দোবস্ত করল। এই পাট্টায় লেখা থাকত কোন ধরণের
প্রথায় সে রাজস্ব দিতে চাইছে, কোন ধরণের ফসল সে চাষ করবে ইত্যাদি।
উল্টোভাবে প্রজাও সরকারকে তার জমি বন্দোবস্ত নেওয়ার কথা স্বীকার করে দলিল করে
দিত। এর নাম হল কবুলিয়ত বা কবুলতি।
অর্থাৎ রাষ্ট্র লিখিতভাবে পাওনা খাজনা বা রাজস্বের দাবি প্রজাকে জানাত, এবং
খাজনা পাওয়ার পর রাষ্ট্র লিখিতভাবে কত পরিমান সে পেয়েছে তা প্রজার কাছে স্বীকার
করে নিত।
মাপজোকের জন্য তাঁর একক ছিল সিকন্দরি গজ(এর আগে আলোচনা করেছি)। আজ যেমন
সেটেলমেন্ট দপ্তরের গান্টার চেন থাকে জরিপের জন্য, এ গান্টার চেন সমান ২২ গজ। শের
শাহের সময় ৬০ গজকে বলা হত ১ জরিপ। এবং ৩৬০০ বর্গগজ ছিল ১ বিঘা।
জমির উর্বরতা বুঝতে জমিগুলিকে তিনভাগে ভাগ করলেন, উত্তম, মধ্যম এবং সাধারণ।
প্রত্যেক মরশুমি ফলনের হার তিন প্রকার জমিতে সরজমিনের ফসল-ফলন থেকে নির্ণয় করা হত।
তারপর এই গড় অঙ্কই হত ফসলটির বিঘা প্রতি ফলনের পরিমান।
সরকারের প্রাপ্য হল এই ফসলের পরিমানের একতৃতীয়াংশ। বিভিন্ন শস্যের এই
বিঘাপ্রতি ফলনের ওপর নগদ অর্থে রাজস্ব দাবির যে তালিকা প্রস্তুত হত তার নাম
দস্তুর।
ধরাযাক বাংলা সুবার গৌড়ের কোন জমিতে আখের ফলন উত্তম জমিতে ২০ মণ, মধ্যম জমিতে
১৫ মণ আর সাধারণ জমিতে ১০ মণ। মোট ফলন
দাঁড়াল ৪৫ মণ। বিঘাপ্রতি গড় দাঁড়াল ৪৫/৩ = ১৫ মণ। সুতরাং জরিপ নিয়মে গৌড়ের আখের
ফলন বিঘা প্রতি ১৫ মন ধরা হবে। কোন চাষীর যদি ৬ বিঘা থাকে, তাহলে তার জমিতে উৎপন্ন
আখের পরিমান হবে ৯০ মণের এক তৃতীয়াংশ ৩০ মণ।
এরকম করে জরিপ নিয়মে প্রত্যেক ফসলের খাজনা নির্দিষ্ট করা হল। চাষী সরকারি
কর্মচারীর কাছে বা রাজস্ব নেওয়ার দপ্তরে তার নির্ধারিত খাজনা নেওয়া হত।
এর সঙ্গে ছিল জায়গীরদারদের বন্দোবস্তের জমি। এরা শের শাহর বড় সেনাপতি ছিলেন -
খাওয়াজ খাঁ, হাজি খাঁ, সুজাত খাঁ ইত্যাদি। এখানে জরিপ নয়, কিসমতিগল্লা প্রথা
চালুছিল। অর্থাৎ তাঁর খাস জমিতে শুধু দুটি চরিত্রে রাজস্ব নিতেন আর জায়গিরদের কিসমতিগল্লায়।
No comments:
Post a Comment