ভারতের উপনিবেশউত্তর সময়ের ইতিহাসের অর্থনীতি চর্চার একটা বড় গবেষণার বিষয় ছিল, ভারত থেকে ব্রিটেনে জ্ঞান-বিজ্ঞান-সম্পদ লুঠের শেকড় খুঁজে বার করা। দাদাভাই নৌরজি-রমেশচন্দ্র দত্ত-গদর পার্টি হয়ে আজকের ভারতপথিক ধরমপালজী হয়ে ক্লদ আলভারেজ হয়ে চন্দ্রকান্ত রাজু হয়ে কলাবতী মুদ্রা - দীর্ঘ সময় ধরে সনাতন ভারত আর তার ঐহিক আর পরমার্থিক সম্পদগুলোকে জানার চেষ্টা শুরু হয়েছে। এইকাজে ব্রিটিশ মনীষার অবদান খুব কম না হলেও অধিকাংশ গবেষণার অন্তঃস্থলে ইওরোপের স্বার্থ প্রাধাণ্য হওয়ায় সেই কাজগুলির গুরুত্ব যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। কলাবতী মুদ্রা যেহেতু বাংলা নিয়েই ভাবিত, ফলে বাংলা লুঠের অত্যাচারের জ্ঞান চুরির তথ্য তত্ত্ব প্রাধান্য পাবে।
তবুও মেট্রোপলিটনের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করার দাবি উঠতে শুরু করেছে। দাবির সরাসরি বিরোধিতায় নেমে পি জে মার্শালেরমত ইতিহাস বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন, ভারতীয় সম্পদ লুঠ করে ব্রিটিশরা যত সম্পদশালী হয়েছে, তার তুলনায় ব্রিটেন ভারতকে অনেক বেশি দিয়েছে। সদাশয় ব্রিটিশ রাজের নানান অদৃশ্য পরিষেবা আর জ্ঞাণের হিসেব ভারতে নিয়ে এসেছে। সেই হিসেব কষতে হবে ভারতকে। ভারতীয় গবেষক বিশেষজ্ঞরা লুঠের হিসেব কষবেন কী, তাঁরা ভারতের সমাজ-রাষ্ট্রের অঙ্গে অঙ্গে ব্রিটিশদের অবদান খুঁড়ে পেতে ব্যস্ত হয়ে উঠছেন। ভারতের কাজে লাগা উন্নততর সেনাবাহিনী আর প্রশাসনের কথা অসম্ভব আচ্ছন্ন চোখে বলেন ঔপনিবেশিকতায়লিপ্ত ঐতিহাসিকেরা। আমরা যেন ভুলে না যাই ভারতীয়দের খাজনায় পোষা উন্নততর সেনাবাহিনী কাজে লেগেছে হাজার হাজার ভারতীয় স্বাধীণতা সংগ্রাম দমনে আর বিদেশি প্রশাসনে কাজ করা হাজার হাজার ইংরেজ আর ভারতীয় সিভিলিয়ানের কাজ হয়েছে ভারত শেষণের নতুনতম পথ দেখানোর।
পি জে মার্শাল পলাশি থেকে ১৭৮৪ পর্যন্ত বার্ষিক নিষ্ক্রমণের হার দেখিয়েছেন পাঁচ লক্ষ পাউন্ডমাত্র। তার বক্তব্য বাঙলা থেকে যে সম্পদ ব্রিটেনে লুঠ করা হয়েছে বলা হয়েছে তারমধ্যে কিছুটা সত্য থাকলেও এটি বৃহত্ অতিকথা মাত্র। মার্শাল অনুগমীদের যুক্তি ১) বাঙলাদেশের কোম্পানির কর্মচারীরা বিদেশি কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করায়, বাঙলার বৈদেশিক বাণিজ্য চক্রবৃদ্ধিহারে বৃদ্ধিপায়। এতে সামগ্রিক লাভ হয়েছে বাঙলারই। বাঙলায় আরও আরও বেশি কাজের পরিবেশ তৈরি হয়েছে, পণ্যের বর্ধিত চাহিদায় আরও বেশি কর্মী শিল্পের কাজে নিযুক্ত হয়েছেন, ২) কোম্পানির উন্নত সেনাবাহিনী বাঙলাকে মারাঠাদেরমত নানান বিদেশি লুঠেরা শক্তির হাত থেকে রক্ষা করেছে।
ইওরোপিয়দের উন্নত প্রশাসন আর আর্থিক ব্যবস্থাপনার লাভ নিয়েছে বাঙলা। বাঙালিরা আজ আর বলেন না, তবুও জঙ্গলমহলে গণগনিরমাঠ এর জলজ্যান্ত উদাহরণ। বাঙলার চুয়াড়, সন্ন্যাসী, আফিম, মালঙ্গী, সাঁওতাল, মুন্ডারি, নীল, খয়রা মাঝি, উত্তরপূর্বের গারো, চাকমা, কুকি স্বাধীণতা সংগ্রাম দমনে এই সমাজগুলি উন্নততর ব্রিটিশ সেনা বাহিনীর অত্যাচারের সাক্ষ্য আজও বহন করছে। আশ্চর্যজনক নয় যে, ব্রিটিশ দমন-পীড়নের উত্তরাধিকার নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী আজও অসম্ভব গর্বিত। অনেকেই বলে থাকেন ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার মাথা উঁচু করে টিকিয়ে রেখেছে তিন ভারতীয় শ্রেণী- উচ্চপদের সরকারি প্রশাসনিক আমলা, বিচার বিভাগ, এবং পুলিশ ঐর সেনাবাহিনী, ৩) এদেশিয় অর্থ আর পরিচালন ব্যবস্থা থেকে ব্রিটেন থেকে আনা পরিচালন ব্যবস্থা ছিল অনেক উন্নত, ৪) ইওরোপিয়রা এদেশে রাজা রামমোহন রায়েরমত গোমস্তা আর বেনিয়ানদের মাধ্যমে দেশের ব্যবসা পরিচালন করত, ফলে দেশে এক ধণিক শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে, তারা শহরে সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এরাই কেউ পরোক্ষে কেউ সরাসরি বাঙলার গণবিদ্রোহদমন করে নবজাগরণের আগ্রদূত অভিধা অর্জন করেছেন ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের থেকে।
No comments:
Post a Comment