মুর্শিদাবাদ
ইংরেজ আমলে রাজধানী কলকাতায় চলে আসার আগে যে শহরে ছিল
তাঁর নাম মুর্শিদাবাদ। যে শহর দেখে ক্লাইভকে বলতে হয়েছিল, এই নগরী লন্ডনের মতই
জনবহুল এবং সমৃদ্ধশালী(সম্পূর্ণ মিথ্যা – তখনো বাংলা লুঠের সম্পদে লন্ডন তথা ইওরোপ
সেজে ওঠেনি) – কিন্তু এখানে যত ধনী মানুষ আছেন, লন্ডনে তা নেই। মুর্শিদাবাদেরই
রাঙ্গামাটি-কানসোনা গ্রামের নামে লুকিয়ে রয়েছে হর্ষবর্ধনকে বিজয়ী শশাঙ্কের
গৌড়তন্ত্রের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ। সেখানে এসেছিলেন হিউএনসাং। হাওড়া-ব্যান্ডেল-আজিমগঞ্জ-বারহাড়োয়া
রেল রাস্তায় কর্ণসুবর্ণ স্টেশন হয়েছে। সেখানে গেলে পুরোন বাংলার প্রাচীন রাজধানীর কিছু উৎখনন দেখা যাবে। আর গাড়িতে গেলে
বহরমপুর থেকে গোকর্ণ হয়ে প্রায় ২৫ কিমি। মুর্শিদাবাদে আগে রাজধানী ছিল ঢাকায়।
মুর্শিদাবাদ এখন বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জেলা। আজও
প্রসিদ্ধ কাঁসা-পিতল বাসন শিল্পের জন্য। বহরমপুরের খাগড়া অঞ্চলে কাঁসা-পিতলের কাজ হয়। নবাবি আমলে এখানকার বাসনের সুনাম ছিল সারা ভারতে। সে সময় খাগড়া অঞ্চলে প্রায় প্রতিটি ঘর থেকে ভেসে আসত ঠুংঠাং আওয়াজ, হাপরের শব্দ। খাগড়ার একটি পাড়ার নাম ‘কাঁসারি পট্টি’। ভৌগলিক কারণেই মুর্শিদাবাদ জেলা প্রসিদ্ধ ছিল তামা-পিতল-কাঁসার বাসনের জন্য। কাঠ আসত গড় জঙ্গল থেকে।এই কাঠের আগুনেই পিতল গলানো হত। আজও খাগড়ায় বেঁচে
আছে কাঁসা পিতলের কাজ।
এককালে মুর্শিদাবাদ ছিল বাংলার রাজধানী এবং বাংলাই ছিল
বিশ্ববাজারের প্রধান রপ্তানিকারক অঞ্চল। বাংলার মুর্শিদাবাদে গড়ে উঠেছিল হাতির
দাঁতের হস্তশিল্পের বিশাল শিল্প। বিশেষ করে মুর্শিদাবাদের নবাবরা বিভিন্ন
হস্তশিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করার সঙ্গে সঙ্গে হাতির দাঁতের শিল্পীদেরও বিপুলভাবে সহায়তা
করা শুরু করেন। আজও বিভিন্ন প্রাসাদে দেখা যায় হাতির দাঁতের কাজ। কয়েক দিন আগে
ক্রিস্টির নিলামে বহরমপুরের হাতিরদাঁতের কারুকার্য ওয়ালা আসবাবপত্রের নিলাম হল
বিপুল দামে। যে কোনও ব্রিটিশ নিলাম কোম্পানির ওয়েবসাইটে অবশ্যি মুর্শিদাবাদের
হাতির দাঁতের নানান শিল্পকর্মের নিদর্শন বিক্রির জন্য রয়েছে।
ব্রিটিশ আমলেও বিদেশিদের লেখায় হাতির দাঁতের কাজের নানান
উল্লেখ পাই। বিশেষ করে বিভিন্ন আমলাদের সমীক্ষায় এবং জেলা পরিচয়ে (ডিস্ট্রিক্ট
গেজেটিয়ার)। ১৮৫১য় আর ১৮৮৮তে সালে লন্ডনের
সাম্রাজ্যের শিল্প প্রদর্শনীতে বিপুল পরিমানে মুর্শিদাবাদের শিল্পীদের হাতির
দাঁতের কাজ ঠাঁই পায়। আর যে কয় দিন বহরমপুরের সেনা ছাউনি ছিল ততদিন সেখানে এই
শিল্প বিকাশ লাভ করেছে। গুরুসদয় দত্তের শিল্প পরিচিতিতে আর ওম্যালির ডিস্ট্রক্ট
গেজেটিয়ারে হাতির দাঁতের কাজের বিষয়টির সামাজিক্তা, অর্থনীতি, বাজার ইত্যাদি বিশদে
বর্ণনা রয়েছে।
আজ এই শিল্পীরা কেউ শোলার শিল্পে কেউবা কাঠের খোদাই
শিল্পে পালিয়ে বেঁচেছেন। এককালে নবাবি আমলে গোটা হাতির দাঁতের আম্বারি তৈরি হত, অর্থাৎ হাতি, তাঁর হাওদা এবং তাঁর ওপর নহবতখানা, আথবা
বিভিন্ন নৌকোর আকার ইত্যাদি তৈরি হত।
আজ শিল্পীরা এই কাজ করেন হয় শোলায় আর কাঠের। এর মধ্যে
কয়েকজন সরকারি নির্দেশনামায় হাতির দাঁতের কাজ করেন তবে তাঁর দাম আকাশ ছোঁয়া। একটা
তিন ইঞ্চি সাধারণ মূর্তির দাম প্রায় বারো হাজার টাকা। কাজ বেশি থাকলে তার দাম
প্রায় দ্বিগুণ। হাতির দাঁত বলে অবাঙ্গালি উত্তরভারতীয়রা এগুলি কিনে থাকে দরদাম না
করেই। এই শিল্পীরা এখন খাগড়ায় থাকেন।
No comments:
Post a Comment