কয়েক হাজার বছর ধরে ১৮০০ সাল পর্যন্ত বিশ্বের অন্যতম ধনী অঞ্চল, বাংলা সুবা শুধু উদ্বৃত্ত অর্থনীতির দেশ ছিল না,
প্রযুক্তিতেও বাংলা ছিল বিশ্বের অন্যতম সেরা জনপদ। বেশকিছু প্রযুক্তি বাংলার নিজস্ব ছিল। দেশজুড়ে বিশ্বদ্যালয়সম
শিক্ষা কেন্দ্র খুলে সে তত্ত্ব তথ্য শিখিয়েছে বিশ্বের নানান সমাজকে। তার নিজের মেধা আর
পরিশ্রমে এতই বিশ্বাস ছিল, সে প্রযুক্তি ভাবনা কেউ চুরি করলেও সেই প্রযুক্তি অতিক্রম
করে নতুন কিছু সৃষ্টি করার যোগ্যতা বিশ্বাস ছিল, তাই কোনও প্রয়ুক্তিই পেটেন্ট করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে নি। অন্তত ১৫০টির বেশি শিল্পদ্রব্য বাঙলার গ্রামীণেরা তৈরি আর ব্যবসা করে এসেছেন ১৮০০ সাল
পর্যন্ত। বিশ্বের শিল্প উত্পদনের প্রায় ৮০ শতাংশ উত্পাদিত হত ভারত,
চিন আর পারস্যে (আজকের ইরাকে)।
এর মধ্যে বাংলার অবদান খুব কম ছিল না কেননা ১৬৮০ সালে শুধু ইওরোপে রপ্তানি হচ্ছে ভারত থেকে
১০ কোটি গজ কাপড় – যা বাড়বে চক্রবৃদ্ধি হারে আগামীদিনে গায়ের জোরে তাঁতিদের শিল্পকর্ম
আর তাঁত বোনার পরিকাঠামো ধ্বংস করে ম্যাঞ্চেস্টারের মিলের জন্য ভারতের বাজারের
দ্বার খুলে না দেওয়া পর্যন্ত। রপ্তানি করা কাপড়ের নব্বই শতাংশ ছিল গ্রাম বাংলার
তাঁতিদের উৎপাদন।
প্রায় প্রত্যেকটি দ্রব্যের বিশ্বজোড়া একচেটিয়া বিশ্ববাজার। অথচ বাঙলার ছোটবড় সব বণিক বা
উত্পাদকেরা সমাজের বিধিনিষেধের আওতার মধ্যে থেকেই বিশ্বজুড়ে ব্যবসা করতেন। দেশে তাদের একচেটিয়া কারবার করতে ভারতীয় সমাজ কোনওদিনও উত্সাহ
দেয় নি। ইওরোপিয় উদ্যমী এবং বণিকদেরমত,
নিজের দেশ অথবা সামগ্রিক বিশ্বের সামাজিক
গঠন পাল্টে অথবা প্রযুক্তির পরিবর্তন ঘটিয়ে
বিশ্ব বাজার দখল করার বিধ্বংসী পরিকল্পনা তৈরি করে নি -
বলাভাল সমাজ করতে দেয় নি। এই উত্পাদন প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত ছিলেন বিকেন্দ্রিভূত কয়েক কোটি উতপাদক কয়েক কোটি বিক্রেতা
– যেন রক্তবীজের বংশধর। আজকের বড় পুঁজির তৈরি করা আইনের মত এঁরা কেউ কারোর শিল্প
বা ব্যবসা দখল – যাকে আইনে বলে হোস্টাইল টেকওভার বা জোর করে কিনে নিতে পারতেন না। এই বিকেন্দ্রীকৃত উত্পাদন ব্যবস্থার বড় অংশিদারিত্ব ছিল
বাঙলার পারম্পরিক শিল্পী-ব্যবসায়ীদের, যাদের উদ্যমকে পরের দিকে অসংগঠিত অথবা
হস্তশিল্প ছাপ মেরে দেওয়া হয়েছে বড় পুঁজির উৎপাদন আর ব্যবসা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্য। ফলে লাভের গুড় সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে না গিয়ে,
কয়েকটি মানুষের সিন্দুকে কেন্দ্রীভূত হয়ে চলেছে। পেছনে সরে গেছে সামাজিক সাম্য। বেড়ে চলেছে কর্পোরেট পুঁজির এলাকা।
শহুরে বাঙালি মধ্যবিত্ত, ব্যবসায়ী থেকে চাকরিজীবী হল
দেশের প্রথম কর্পোরেট তাত্ত্বিক দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময়ের কিছু আগে থেকে। ইওরোপিয় আধিপত্য বিকাশের সঙ্গে চাকরি আর দালালির টোপ দিয়ে বাঙালি উচ্চমধ্যবিত্ত সাম্রাজ্যের লুঠের ছোট অংশিদার করে নেওয়া হল। এই চাকুরীজীবীদের হাত দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রথমে বাঙলা-বিহার, পরে সারা ভারতের জনপদে অসীম অত্যাচার, দখল-ধ্বংসমূলক বাণিজ্য এবং উত্পাদনের পরিকাঠামো ধ্বংস করায় অযুত গ্রামীণ কারিগরের স্বনির্ভরতার
বিলয়, বাংলার
বিশ্বজয়ী বণিকদের পরাধীণতা, বাংলার অর্থনীতি-প্রযুক্তির ধংসের যুগ শুরু হল।
হাজার হাজার বছরের গ্রামভিত্তিক পঞ্চায়েতি গণতন্ত্র
ধ্বংস করে শহরকেন্দ্রিক পশ্চিমি সংসদীয় গণতন্ত্রের বনিয়াদ যত দৃঢ় হচ্ছে, ভারতের মাটিতে ততই গ্রাম-শিল্পী-উদ্যমীরা বিলুপ্তপ্রায় হচ্ছেন। এই কাজের ঋত্ত্বিক ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি সরকারি আর বড় পুঁজির আমলারা। তাদের পরিকল্পনায়
আগ্রাসী কর্পোরেট বাজারের বিপুল খাঁই আর বড় পুঁজির নিশ্ছিদ্র লুঠ
চাহিদা সফল করতে গ্রামীণ উৎপাদক আর বিক্রেতারা রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় হয়ে গেলেন
উদ্বৃত্ত। ইংরেজ আমল থেকেই এদের গরীব, আনপড়, অজ্ঞাণী, পরনির্ভর, আদিবাসী, প্রান্তিক, তপশিলী জাতি উপজাতি ইত্যাদিরূপে চিহ্নিত করার যে চেষ্টা চলেছে,
তার প্রভাব পড়েছে স্বাধীণতার পরের
সরকারি-বেসরকারি
পরিকল্পনায়। ফলে অদম্য ভারতীয় তথা বাঙলার সভ্যতা সৃষ্টিকারী শিল্পী-উদ্যমী থেকে স্বাধীণতার পর থেকে নানান
উদ্যমে, গ্রাম শিল্পীদের পিঠে
সাধারণ দিনমজুর, খেটেখাওয়া, গরীব, বিপিএল, অথবা করুণাযোগ্য হস্তশিল্পীর অনপনেয় ছাপ পড়ে গিয়েছে। এরা সকলেই যে দাগি শ্রমিক
সরকারি পরিকল্পনা আর অনুদানরাশিতে তা স্পষ্ট। পারম্পরিক শিল্পীরা বিপিএলশ্রমকার্ডধারী,
ভারত সরকারের বছরের একশ দিনের কাজের পরিকল্পনার কয়েকশ টাকার মাটি কাটার মজুরমাত্র। সামাজিক নিরাপত্তা প্রায় শূন্য,
রোজগারও তথৈবচ,
লুঠ হয়ে যাওয়া সামাজিক সম্মানের কথা যত কম বলাযায় তত ভাল।
তবুও নতুন সময়ে
নতুনভাবে, মধ্যবিত্ত
প্রজন্মের একটি অংশ সামাজিকভাবে আবার শেকড়ে ফিরতে চাইছেন,
এটিই সব থেকে বল-ভারসার কথা –
তাই কলকাতা তথা জেলার নানান শিল্প মেলায়
বিক্রি বাড়ছে – নতুন করে
তাঁরা তাঁদের ঐতিহ্যকে দেখতে চাইছেন – নতুন করে সম্মান ফিরিয়ে দিতে চাইছেন এই
গ্রামীণ উতপাদকেদের। শহরের নতুনতম প্রজন্মের দিকে গ্রাম
শিল্পীদেরও নতুন প্রজন্ম তাকিয়ে
রয়েছেন বড় আশায়। এই শেকড়ছেঁড়া উদ্দাম সময়ে বৃন্দাবন চন্দ, মধুমঙ্গল মালাকার, গীতা
কর্মকার বা নিতাই নন্দীমত
শিল্পীদের এবং তাঁদের
উত্তরাধিকারীদের সবলে টিকে থাকা একান্ত প্রয়োজন। কেননা তাঁরা আজও ধরে রেখেছেন সেই কয়েক হাজার বছরের আজেয়
বাংলার নিজস্ব প্রযুক্তি, যে প্রযুক্তির বলে এই অনবদ্য সম্মানীয় মানুষগুলি বলতে
পারেন, তাঁরা বিন্দুমাত্র বিদ্যুৎ ব্যবহার না করে, স্থানীয় উপাদান ব্যবহার করে,
স্থানীয় মানুষকে রোজগার দিয়ে, পরিবেশের কম ক্ষতি করে, কমতম সম্পদ ব্যবহার করে
গ্রামীণদের বাজারের চাহিদা পূরণ করছেন। এঁরা নিজেরা তৈরি করেছেন সংগঠন। কারোর দয়ায়
নয়, নিজেদেরই বলে বাঁচতে চাইছেন। এঁরা বাঁচলে তবেই বাঙলার শিল্প-প্রযুক্তির ইতিহাস বাঁচবে বাংলার ঐতিহ্য পরম্পরা বাঁচবে, বাংলা তার নিজস্ব পরিচয়ে
বাঁচবে। আশ্বাসের কথা মধ্যবিত্ত নতুন প্রজন্ম বোধ হয় সেটুকু বুঝতে পেরেছেন। এই গাওনা গেয়ে আমরা আমাদের জেলাওয়ারি কারুশিল্প পরিক্রমা
শুরু করি।
No comments:
Post a Comment