অবিভক্ত মেদিনীপুর
মাদুর
দুই জেলারই অন্যতম প্রধান হস্ত শিল্প
মাদুর। বাংলার মাটির ঘরে মাদুরের প্রয়োজনীয়তা, গরমে মাদুরে শোয়ার আরাম, কাঁচামালের
সহজ লভ্যতা, নয়নাভিরামতা, দামের স্বল্পতা, আরামপ্রদতা এবং বিপুল ঐতিহ্যের সঙ্গে
জুড়ে থাকার ইচ্ছের জন্য মাদুর গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে আজও নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণ
হিসেবে গণ্য হয়। বাংলার নানান গ্রামীণ গল্পে, রূপকথায়,
পূর্ববঙ্গগীতিকায় বারংবার মাদুরের কথা, মাদুর নিয়ে নানা উপমা, মাদুরের নানান
প্রকারের কথা উঠে এসেছে। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা বলেন সরস্বতী-হরপ্পা সভ্যতায়ও মাদুর
বোনা হত (http://lokfolk.blogspot.in/2009/08/matinduatruofsabong.html)।
মুঘল আমলে ভারত ভ্রমণে আসা
তাভার্নিয়ের মত নানান ব্যবসায়ী মাদুরের কথা উল্লেখ করছেন। মাদুর যে বিপুল পরিমাণে
ভারতের, নানান এলাকায় ভারতের বাইরে নানান
এলাকায় রপ্তানি হত তার কথা উল্লেখও করছেন। বাংলার শিল্পীরা এমন
দক্ষতায় মাদুর বানাতেন, সেই এত সূক্ষ্ম যেন কাপড়। তার ওপর সাপ বয়ে যেতে পারত না।
আজও মাদুরের ওপর কাজ, মাদুরের কাঠির সূক্ষ্মতা, তার বুননের দক্ষতা ওপর নির্ভর করে
মাদুরের চাহিদা আর দাম। ব্রিটিশ আমলে ওম্যালি, পোর্টার এবং স্বাধীনতার পরে
প্রশাসক আশোক মিত্রের মত বহু মাদুর বিষয়ে মাথা ঘামিয়েছেন। সারা দেশে এমনকি হাওড়া,
উত্তর ২৪ পরগণা আর দিনাজপুরেরও কিছু মাদুর বোনা হলেও, দুই মেদিনীপুর কিন্তু সারা
বিশ্বে মাদুর তৈরির জন্য প্রখ্যাত।
মাদুরের মূল উপাদান এক ধরনের তৃণ– সাধারণতঃ যা মাদুরকাঠি নামে পরিচিত। মাদুরকাঠি সরু,
গোলাকার, দৈর্ঘে চার হাত বা একটু বড়,
কোনো গাঁট থাকে না বা শাখা প্রশাখাও হয়
না। তৃণ শীর্ষে চার পাঁচটি ধারালে পাতা থাকে। মাদুর কাঠির চাষ হয় সাধারণতঃ পূর্ব আর
পশ্চিম মেদিনীপুর, দক্ষিণ আর উত্তর ২৪ পরগণা, আর হাওড়া জেলায়।
বাংলার মাদুর সাধারণতঃ তিন ধরণের – একহারা, দোহারা আর মসলন্দ। কাঠি তৈরির জন্য প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন ছুরি। একে গেঁজে ছুরি বলে। এক হারা মাদুর বোনার জন্য প্রয়োজন,
মাদুর কাঠি,
সুতলি, টানা দেওয়ার জন্য ৪টে বাঁশের খুঁটি,
টানা বাঁধার জন্য ২ খানা সোজা বাঁশ,
দুটি মোটা দড়ি,
শালকাঠের শানা (প্রতি ৯ ইঞ্চিতে ১৪ থেকে ১৬টা ফুটো),
একটা তক্তা,
কাছি ভেজাবার জন্য পাত্র। দোহারা মাদুরের জন্য প্রয়োজন এ সবই
কিন্তু শানার জন্য প্রতি ৯ ইঞ্চিতে ৯ থেকে ১০টা। মসলন্দ মাদুরের জন্য আরও প্রয়োজন গোল
বাঁশের চটা। শানায়ও তারতম্য হয় প্রতি ৯ ইঞ্চিতে ২৮ থেকে ৪৮। মসলন্দ মাদুরের কাঠি থেকে মাঝখানের সাদা
অংশটি ছেঁটে বাদ দিতে হয়।
মাদুরের নকশা অনুসারে যতটুকু অংশ রং করার দরকার হয়,
সেই অংশ টুকুর দুধারে ভাল করে বাঁধেন
কারিগরেরা, তার পর
সেদ্ধ করে নিতে হয় কম করে আট ঘন্টা। রং পাকা করার সময় নুন আর তেল ব্যবহার করা হয়। মাদুরকাঠি রংএর জন্য ব্যবহার হয় সবং
এলাকার একধরনের গাছের পাতা। সাধারণতঃ ভারতের অন্যান্য গ্রাম শিল্পের মতই
মাদুর শিল্পীরা বংশ পরম্পরায় এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন। তবে এলাকা তারতম্যে মাদুর বুননের
পার্থক্য রয়েছে।
No comments:
Post a Comment