পুরুলিয়া
পুরুলিয়ার গ্রাম শিল্প বললেই মনে পড়ে ছো (ছৌ নয় ছো - মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার জঙ্গলমহলে আজও দৈনন্দিনের নানান অনুষঙ্গে ছো শব্দটি অবলীলায় ব্যবহার করেন গ্রামীণেরা) মুখোশ আর ছো নাচ। সেই শিল্পকর্মের
একমাত্র গ্রাম চড়িদা স্থানীয় ভাষায় চোড়দা, শহুরে পালিশ-ভাষায় চড়িদা। তাই এই গ্রামে ভ্রমণ শুধুমাত্র হপ্তাশেষে আপিসবাবুর পকেট
বাঁচিয়ে পরিবারের মন ভোলানো ডিজনিল্যান্ড ভ্রমণ নয়,
শস্তাতম ছো দেখানো গাইড বই হাতে করে চোখে
ঠুলি কানে ইয়ারপ্লাগিয় ধরতক্তা-মারপেরেক-গোছের পুরুলিয়ার পানে বেরিয়ে পড়া নয়,
কলম হাতে যেনতেনপ্রকারেন ভ্রমণ কথা লেখা
নয়, চড়িদা
গ্রাম বাঙালি ভ্রমণার্থীদের সাংস্কৃতিক তীর্থ। কে না জানে তীর্থে মাঝেমধ্যেই মাথা
ঠেকাতে যেতে হয়।
হাওড়া থেকে রাতে হাওড়া-চক্রধরপুর ধরে বরাভূম অথবা হাওড়া থেকে রূপসী বাংলায় পুরুলিয়া শহর। অথবা পুরুলিয়া থেকে বাগমুন্ডি
পাহাড়গামী গাড়িতে সত্তর কিলোমিটারের কাছাকাছি অযোধ্যা মোড়। আড়াই ঘন্টারমত। গ্রামে আসতে আসতে চোখ চলে যায় দু’পাশের শূন্য প্রান্তরের বন্য সৌন্দর্যে। গ্রামে ঢোকার পথে অযোধ্যার মোড়ে ছোট বসতি। দু’পা দূরে চড়িদা গ্রাম।পারম্পরিক
শিল্পীদের সংগঠণ বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘর অন্যতম সম্পাদক,
কলামণি পুরস্কার বিজয়ী মুখোশ শিল্পী,
গায়ক, নর্তক, শিল্পগুরু নেপাল সূত্রধরের বাড়ি
চড়িদায়। তিন প্রজন্ম সুমধুরভাবে জড়িয়ে রয়েছেন
এই কলায়। পটিদারদের
মতই চড়িদায় খুব কম ঘরই আছে যেখান থেকে এক জনও ছো শিল্পী ইউরোপ-আমেরিকায় অনুষ্ঠান করতে যাননি। নেপাল বহুবার বিদেশে গিয়েছেন মূর্তি তৈরি করতে, কর্মশালা পরিচালন করতে। মূর্তি তৈরিতেও তার নামডাক। বিশ্বে বহু জাদুঘরে তাঁর তৈরি প্রতিমা
আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে।
প্রায় ৮০টি পরিবার নিয়ে এই গ্রাম। গুরুপ্রতীম নেপাল সূত্রধরেরমতই প্রতি বাড়িতে একই দৃশ্য। বাড়ির দালানে বসে পরিবারের বড়
থেকে ছোট, প্রায় সব সদস্যই ছো নাচের মুখোশ তৈরিতে ব্যস্ত। ব্যস্ততার মধ্যেও ঘুরতে আসা ভ্রমণার্থীর নানান চালাকিময় প্রশ্নের উত্তর দেন ধৈর্য ধরে হাসিমুখে। শিল্পীর
ব্যক্তিত্বপূর্ণ হাসিটা ধরাথাকে ঠোঁটে। গ্রামীণ সলজ্জতা আর বিনম্রতা কথায় চলকে
ওঠে।
পরম্পরার সঙ্গে সঙ্গে নতুন ধারায় কাজ করছে নেপাল সূত্রধরের ভাইপো
ধর্মেন্দ্র। নিজের মত করে সৃষ্টির কাজ করে চলেছে সে। ঘরে দুর্গা, গণেশ, শিব, অসুরের মুখোশ নিয়ে বাস। আকার বিভিন্ন ধরনের। কিনেও ফেলাযায়। নাচ দেখতে চাইলে আগে থেকে যোগাযোগ করতে হয়।
পদ্মশ্রী গম্ভীর সিং মুড়ার নাম জুড়ে আছে চড়িদার সঙ্গে,
নেপাল সূত্রধরও গম্ভীর সিংএর দলের শিল্পী ছিলেন। যে গুরুর হাত ধরে ছো নাচ এ গ্রামকে বিদেশে নিয়ে
গিয়েছে, কথায়
কথায় সেই পূর্বজর প্রতি প্রণাম জানান নেপাল। শিল্পীদের মহড়া দেওয়ার জন্য
গ্রামের মাঝখানে একটি ছোটখাটো হল আর গ্রামে ঢোকার মুখেই আছে গম্ভীর সিংহের মূর্তি।
বরাভূম স্টেশনে নেমে চড়িদা আসার পুরো রাস্তা জুড়ে প্রচুর খেজুর গাছ। শীতের সকালে মন খেজুর রসের বায়না করলে এই মুখোশময় চড়িদাতেও তা মিলবে। শীতের সকলে খেজুর গুড় বানানোর বিরল দৃশ্যও এ গ্রামে দেখাযাবে। চাইলে গুড় কেনা যায়। জঙ্গল মহলের গুড়ের স্বাদই আলাদা। সুবোধ ঘোষ বোধহয় এই রসেরই ভিয়েন চড়িয়েছেন গল্পে।
পিছন পাহাড়ের পাদদেশে জঙ্গলে হদহদি ঝরনা। শীতকালে জল নেই কিন্তু বর্ষায় দেখনদারি। শাল, বয়ড়া, আমলকীর ঘন জঙ্গল পেরিয়ে পাহাড়ের গায়ে ঝরনাটি বেশ
মনোরম। হদহদিতে গিয়ে জল দেখতে না পেলেও চুপ করে বসে থাকলেও নানা পাখির ডাক মন ভরিয়ে দেবে। সমতল থেকে ৭০০ মিটার উচ্চতায় অযোধ্যা পাহাড়ে
জঙ্গলের রাস্তা বেয়ে থুর্গা লেক। বৃষ্টির জলই এই লেকটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
বর্ষায় এর রূপ অনন্য। কিছু দূরে বাঘমুন্ডি গ্রাম। অযোধ্যা
ওবাঘমুন্ডির জলের একমাত্র উৎস থুর্গা লেক। বিশাল লেকের ঠান্ডা হাওয়া মন জুড়িয়ে দেয়।
গালা
পুরুলিয়া শহরে গালার গয়না তৈরি হয়। সাধারণত মুসলমান
কারিগরেরা যা তৈরি করেন, তাঁর অধিকাংশ বিক্রি হয় বাংলার বাইরেই। শহরে সাহেব বাঁধ
দেখা ছাড়া এই গালার শিল্পীদের পাড়ায় ঘোরা অন্যতম কাজ হবে।
রঘুনাথপুরের তসর
রঘুনাথপুরের তসর আপনার মন ভরাবেই কেননা এখানকার তসর
সাধারণত কলকাতায় আসে না। এলেও এত কম সংখ্যায় আসে যে তাঁর হিসেব থাকে না প্রায়। ফলে
আপনি যদি রঘুনাথপুরের তসর পরেন তা হলে মনে হবে এটি সব্বার থেকে এক্কেবারে আলাদা।
আর রঘুনাথপুরেই বিষ্ণুপুরের রাজ্য পুরষ্কার বিজয়ী নিতাই
নন্দী বাস বসিয়েছেন। সেখানেই তিনি শাঁখের কাজ করছেন এবং তাঁর নবত্ম প্রকল্প,
নারকেলের মালা দিয়ে জিনিসপত্র বানানোর কাজ করছেন। শীতের সকালে রঘুনাথপুরের জয়চণ্ডী
পাহাড় ছাড়াও নিতাই নন্দীর শাঁখের আর নারকেল মালার কাজ আর মনোজের তসর কিন্তু অবশ্যই
দ্রষ্টব্য।
No comments:
Post a Comment