পিতল-কাঁসার সুদিন নবদ্বীপে চৈতন্যজন্মের বহু আগে থেকেই ছিল। অষ্টাদশ শতকে এর ব্যাপক সাড়া ভারতে ছড়ায়। নবদ্বীপের উপর লেখা অন্যতম প্রামাণ্য বই ‘নবদ্বীপ মহিমা’তে কান্তিচন্দ্র রাঢ়ী লিখেছেন, ১৮ শতকের গোড়ার দিকে নবদ্বীপের কাঁসা-পিতল ব্যবসায়ী গুরুদাস দাসের সারা ভারতে মোট ৮০০ জায়গায় দোকান ছিল। তাঁর তখন বার্ষিক উপার্জন ছিল এক কোটি টাকা। সবই কাঁসা-পিতলের সৌজন্যে।
নবদ্বীপের কাঁসা-পিতল শিল্পের এক বিশেষ নির্মাণশৈলী “ঠোকাই” পদ্ধতিতে সরু মোটা নানা ধরনের লোহার ছেনি, যার মাথা ভোঁতা, কাঠের হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে ঠুকে পিতলের ধাতব পাতের উপর নজরকাড়া নকশা আঁকেন এখানকার পিতল-কাঁসার কারিগরেরা।চৈতন্যজন্মের অনেক আগে থেকেই নবদ্বীপ কাঁসা-পিতল শিল্পের জন্য সারা ভারতে পরিচিত ছিল। ঠোকাই পদ্ধতির প্রয়োগ নবদ্বীপের এই শিল্পকে দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে খ্যাতির শীর্ষে রেখেছিল।
কয়েক বছর আগেও সংগঠনের জেলা
সম্পাদক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ পাল। তাঁর মূল ব্যবসা দেবী মূর্তির শস্ত্রগুলি, বিশেষ
করে দেবী দুর্গার প্রহরণগুলি দিয়ে উঠতে পারেন না। বছরে তাঁর কয়েক লক্ষ টাকার বরাত
থাকে, কিন্তু ছেলেরা টাকা তোলার কম্পানিতে গিয়েছে। ফলে তিনি এর কয়েক ভগ্নাংশই দিতে পারেন।
অন্য দিকে মাটিয়ারির
কাঁসা-পিতলের নানান তৈজস। কাটোয়া রেল রাস্তায় দাঁইহাট হয়ে গঙ্গা পেরিয়ে আর শিয়ালদা-কৃষ্ণগর-লালগোলা
রাস্তায় দেবগ্রামে নেমে বাসে প্রায় এক ঘন্টা মাটিয়ারি ধর্মদা মুড়াগাছা সাধনপাড়া। ব্রিটিশ আমলে কালীগঞ্জ থানার মাটিয়ারির হ্যাজাক কব্জা করে ফেলেছিল কলকাতা ঢাকা কটক লখনো চাটগাঁ। বরযাত্রীরা ফিরতে পারত না সেনকিট হ্যাজাকের জ্যোৎস্না ছাড়া। সে যুগ গিয়েছে, কিন্তু আজও বুড়ো হাড়ে ভেল্কি দেখান নরহরি বর্মনরা।
এক সময় উলা-বীরনগরের খ্যাতি ছিল
কাঠের কাজে। বিনয় ঘোষ আজ থেকে সত্তর বছর আগে দেখেছিলেন মিত্র-মস্তৌফিদের বাড়ির
কড়ি, বা অন্যান্য আসবাবের কাঠের কাজ।
সে দিন আর নেই কিন্তু পাশের তাহেরপুরের সরা আজও তাঁর খ্যাতি ধরে রেখেছে। রানাঘাট কৃষ্ণনগর ভায়া বাদকুল্লা বীরনগর রুটের বাসরাস্তা নিমতলা গ্রামের মাঝ দিয়ে চলে গেছে। তাহেরপুরের নিমতলা গ্রামে পটশিল্পী হিসেবে পরিচিত প্রায় পঞ্চাশটি পরিবার আছে।দশরথ পাল
সুকুমার দাসেরা আজও সরা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
সরা শিল্পীরা প্রথমে মাটি ছেনে মাটির তালকে হাতের দুতালুর চাপে রুটির মত গোল
আকৃতি দেন এর নাম চরা কাটা। এবার ঐ সরা আকৃতির তালকে কেনো পকা সরার ওপরে রেখে জলমাটির(ঘোলা) তরল মিশ্রণে ভেজানো পাতলা ন্যাকড়ার
সাহায্যে মসৃণ করা হয়। এবারে কিছুক্ষণ ছায়ায় রেখে সেটিকে শোকানো হয়। এরপর ভাটিতে পোড়ানোর জন্য যায় এই সরা। তাঁর পর রং করার কাজ।
পঞ্চকল্যাণী পটের বংশাবলীর মধ্য থেকে সরার জন্ম, এরকম প্রবাদ চালু। লক্ষ্মীপজোয় উপলে ধানের শীষ, কলমী, পদ্ম, প্যাঁচা, কৃষ্ণ-রাধা বা
দুর্গা মূর্তির সরা আজও পাওয়া যায়। সরার পাড়ে লাল রঙে এক আঙ্গুল পরিমাণ পাড় এঁকে
মূল দেবীচিত্রের সঙ্গে নানাবিধ সহচরী মূর্তি বা পুতলি আঁকার প্রবণতা দেখা যায় –
এলাকা অনুযায়ী এই পুতলির সংখ্যা বাড়ে বা কমে।
পুরাকালে মানে অতীতে ঘট পটে অর্থাৎ সরা আর ঘটে পুজো হত।
লক্ষ্মীর পটে শুধু তিনি থাকেন না, সঙ্গে নানান সহচরী থাকেন। কোনও কোনওতে
লক্ষ্মী-নারায়ণ অথবা রাধা-কৃষ্ণ থাকেন।
বাংলাদেশের ঢাকাই সরা বা ফরিদপুরের সরার নিজস্ব আঁকার পদ্ধতি রয়েছে। ঢাকাই সরার দেবদেবী আঁকার নিচের দিকে থাকে একটি নাওএর
প্রতিমা আর ফরিদপুরের সরাতে দেবদেবীরা সাধারণতঃ একটি চৌখুপির মধ্যে থাকেন। ফরিদপুরের সুরেশ্বরী সরার উপরিঅংশে সপরিবারে মহিসাসুরমর্দিনীর ছবি আঁকা হয়,
আর নিচে সবাহন লক্ষ্মীমূর্তি থাকেন। তাহেরপুরেও ফরিদপুরের অঙ্কণ শৈলী আনুসরণ করা হয়। সরা চার প্রকার। পরিদপুরী
সরা, সুরেশ্বরী সরা, গণকী সরা আর ঢাকাই সরা। ঢাকাই সরার কানা উঁচু। লক্ষ্মী-নারায়ণ
মুখোমুখী দাঁড়ানো থাকেন। হাতে ধানের শীষ, দেবীর পায়ের কাছে রত্নভাণ্ডার আর
প্যাঁচা। নিচের দিকে নাওএর আঁকা হয়। ফরিদপুরী সরার কানা উঁচু নয়। দেব্দেবীরা
সাধারণত চৌখুপির মধ্যে থাকেন। সুরেশ্বরীর পট পাঁচ ভাগে বিভক্ত। মাঝে থাকেন
লক্ষ্মীদেবী। ওপরে সপরিবারে দেবী দুর্গা। গণকীর পটভূমি লাল, কিনারা কালো। পটে
থাকেন দেবী দুর্গা আর তাঁর পরিবার। নিচে লক্ষ্মী আর তাঁর বাহন।
No comments:
Post a Comment