নিভিছে দেউটি – ডোকরা শিল্প
দুর্গাপুরের দিক থেকে যামিনী আর তাঁর ভাই
বসন্তরঞ্জনের রায়ের গ্রাম বেলেতোড়ে কড়ে আঙ্গুলের আকারের ছানার লম্বা লম্বা রসে
ভেজা মিষ্টিতে মিষ্টিতে ভরপুর নিখুঁতি(বাংলায় তিন রকম নিখুঁতি একটা বেলেতোড়ের,
অন্যটা বর্ধমানের সীতাভোগের সঙ্গী, একটা কৃষ্ণনগরেরটা আনেকটা দানাদারের আঙ্গিকের)
আর আরও বেশি মিষ্টি মেচা-র স্বাদ আস্বাদন করে আপনি যখন বাঁকুড়া শহরে ঢুকবেন ঢুকবেন
করছেন তখন আশেপাশে নজর করলে দেখবেন বিকনা এসেছে। আধুনিকতা
আর বড় পুঁজির স্বার্থে রাস্তা চওড়া হওয়ায় পুরোনো রাস্তার পাশের ডোকরা পাড়ার সব
চিহ্ন প্রায় লুপ্ত হয়ে গিয়েছে তবু একটু খঁজলেই পাড়ার মানুষ আপনাকে দেখিয়ে দেবে
শিল্পডাঙ্গা যাবার রাস্তা।
একদা ভারতের বিপুল পরিমাণবৈদেশিক রপ্তানির একটা
বিপুল অংশ ছিল লোহা-ইস্পাত। বাঁকুড়া-বীরভূমের বিস্তীর্ণ এলাকায় ছিল সাঁওতালসহ
অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোহা গলানোর কারখানা। আর সেই গলানো লোহা নিয়ে কামার শাল
চালাতেন এই সম্প্রদায়ের বাইরের মানুষেরা সাধারণতঃ কামার সম্প্রদায়েরা। কিন্তু
শিল্পগ্রামে ঢুকলেই বুঝবেন এখানকার কোনও কিছুই আর শিল্পীত নেই। সব
কিছুই রুখা শুখা। বাতাসে চাপা মদের গন্ধ, খোলা নর্দমায় নাক ঢাকে। এই মানুষগুলি
কয়েক কাহার বছর ধরে ছিলেন যাযাবর। কখোনো এ গ্রাম কখোনো ও গ্রামে গিয়ে গ্রামীণদের
সংসারের নানান ধাতুর চাহিদা মেটাতেন তাঁর বর্ণনা রয়েছে কমলকুমারের লেখায়। ধরমপালজী
বলছেন ১৯০০র আশেপাশে ডোকরা কামারদের সারা ভারতে এই ধরণের স্থানান্তর যোগ্য চলমান চুল্লির
সংখ্যা ছিল ৩০ হাজার। প্রত্যেকটি চুল্লি প্রত্যেক বছর ৩৮ থেকে ৩২ সপ্তাহ জুড়ে ২০
টনের বেশি লোহা গলিয়ে নানান তৈজস এবং নানান দরকারি দ্রব্য তৈরি করতে পারতেন এদের
তৈরি ধাতু পিণ্ড রপ্তানি হত বিদেশে - বিশেষ করে আরবে যেখানে তৈরি হত দামাস্কাস তরোয়াল। এঁরা
সক্কলে বাবা বিশ্বকর্মার সন্তান। কারোর উপাধি কর্মকার, কারোর লোহার, কেউ কামার,
কেউ আআবার স্বয়ং বিশ্বকর্মা – বস্তারের সোনাধর বিশ্বকর্মা পৈয়াম। ভারতের
বিশ্বকর্মাদের ওপর ভাস্কর মীরা মুখোপাধ্যায়ের একটি আবিস্মরণীয় বই পড়তে পারেন
বিশ্বকর্মার সন্ধানে বা ইন সার্চ অব বিশ্বকর্মা। পরিকল্পনা করে ১৮০০ সালের পর যে
বিশিল্পায়নে ক্রমশঃ ধ্বংস হতে থাকে ভারতের নিজস্ব লোহা-ইস্পাত শিল্পের বিকশিত
পরিকাঠামো।
তো এই যাযাবর মানুষগুলিকে স্বাধীনতার পর গৃহী
পরিকল্পকরা রাষ্ট্রের কর্তারা এদের ঘুরে বেড়াবার দুঃখ না দেখতে পেরে বসিয়ে দিলেন
বাংলার দুই অঞ্চল বাঁকুড়া আর বর্ধমানের গুশকরারা কাছে সাধুর বাগানে। এদের দফা রফা
হওয়ার যতটুকু বাকি ছিল সব শেষ। যে মানুষদের গৃহীদের মত জমাবার অভ্যেস নেই, যে
মানুষদের নিজস্ব সম্পত্তি বলতে শুধুই বংশ পরম্পরায় অধীত অর্জিত জ্ঞান, সে মানুষদের
যখন বসিয়ে তাদের হাজার হাজার বছরের অভ্যেস পাল্টে ভাল করবার জন্য গৃহী বানিয়ে
দেওয়া হলে, যা হবার তাই হয়েছে।
আজ এদের বুশ্বাস, আচার আচরণ, সম্পর্ক ইত্যাদির
সঙ্গে শিল্পকর্মটাও প্রায়-সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, কিন্তু ধাতুর ওপরে জং না
পড়ার প্রযুক্তিটা এঁরা আজও ধরে রয়েছেন, ধরে রয়েছেন লস্ট ওয়াক্স পদ্ধতিতে তৈরি করা
ধাতুর নানান শিল্প। কেন এই পদ্ধতিতে জং পড়ে না তাই নিয়ে
তথাকথিত পশ্চিমি ধাতু বিশেষজ্ঞ মহলে আনুমানের পর আনুমানের বন্যা। কেউ আজও ভালকরে
জানেন না কেন অন্তত দশ হাজার বছর পুরোনো এশিয়া বা আফ্রিকার এই লস্ট ওয়াক্স নামক
আদিম পদ্ধতিতে জং পড়ে না। এই লেখায় সে পদ্ধতি বিশদে বর্ণনা করলাম না। কোনও দিন যদি
বাঁকুড়া যান, ভাগ্য ভাল থাকলে আপনারা দেখতে পাবেন কিভাবে মাটির ছাঁচ বানিয়ে তাতে মোম
দিয়ে একটার পর একটা আংশ জোড়া হচ্ছে। গীতা কর্মকার এক প্রবাদপ্রতীম শিল্পী। আজ সেখানে
খুব বেশি থাকেন না গীতাদি। তাঁর এক ছেলে সেই
শিল্পডাঙ্গায় থাকেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলে যদি যাওয়া যায় তাহলে সেই আদিম কিন্তু
অত্যন্ত আধুনিক এই প্রযুক্তিটি চাক্ষুষ দেখতে পাবেন।
No comments:
Post a Comment