বীরভূম
সেরপাই
বীরভূমের সিউড়ির কাছের এক গ্রাম, লোকপুর খ্যাত সেরপাই-এর জন্য। একদা প্রত্যেক
অর্থনৈতিক কাঠামোর বাঙালি বাড়ির ভাঁড়ার ঘরে থাকত দানা শস্য মাপার
নানান রকম উপাচার। কোথাও কাঠ, কোথাও ধাতু, কোথাও বেত যে এলাকায় যা পাওয়া যায়, তাই
দিয়ে তৈরি হত এই জিনিসটি। কেউ বলতেন কুনকে, কেউ বলতেন কাঁপা, কেউবা অন্যকিছু।
বীরভূমে যেহেতু ধাতুর প্রাবল্য বেশি তাই বীরভূমে তৈরি হত ধাতুর মাপনি। তো লোকপুরের
শিল্পীরা এই মাপনিকে নতুন এক শৈল্পিক অবয়ব দান করল। নাম হল সেরপাই। সেই থেকে পাই
পর্যন্ত নানান ধরণের মাপনি থরে থরে সাজানো – যখন এটি ঘর সাজাবার উপকরণ হিসেবে তৈরি
হতে শুরু করল, তখন আর তাকে মাপার উপযোগী করার প্রয়োজন হয়ে পড়ল না। ইংরেজিতে সিউড়ি
বোল। শহুরে বাবু কংগ্রেসের সদস্যরা নেতাদের চাপে, গান্ধীজীর ডাকে ১৯২০-৩০ সালের
দিকে যখন খুঁজতে বেরোলো গ্রাম কেমন দেখতে, গ্রামের নানান বিষয়, সেই সময় সিউড়িতে
গিয়ে এধরণের একটি জিনিস দেখে তাঁরা মুগ্ধ হয়ে ঐ নামকরণ করেছিলেন। একদা গোটা গ্রাম
করতেন। আজ শুধুই করেন একটি পরিবার ভোলানাথ কর্মকার।
ভোলানাথ শুধু বাংলাই নয়, ভারতের নানান স্থানে বেশ নাম কুড়িয়েছেন সেরপাই তৈরির জন্য। ভোলানাথ এই
শিল্পটি শিখেছেন তাঁর শ্বশুর মশাই কার্তিক কর্মকারের কাছ থেকে। আর যেহেতু
লৌকিক শিল্পীদের পরিবারও সাধারণভাবে তাঁদের নানান কাজে হাত লাগান, সেরপাই তৈরিতে ভোলানাথের স্ত্রী রুমা আর কন্যা পুতুলও যথেষ্ট দক্ষ,
কিন্তু তাঁরা ভোলানাথের সহকর্মীরূপেই বেশি কাজ করতে উতসাহী।
আগে আমকাঠ দিয়ে তৈরি হত সেরপাই, এখন হয় সেনাঝুরি দিয়ে। নির্দিষ্ট মাপ অনুযায়ী কেটে যে
পাত্র বা খোনাটি তৈরি হয়, তার নাম ডোল। একে ঘসে
মসৃণ করা হয়। ভুষো কালি, শিরিষ আঠা আর রজন
দিয়ে কালো রং করা হয়। এর পর নকশা তৈরির পালা।
এর পর বাইরে তৈরি হয় পিতলের কারুকাজ, পিতলের পাত কেটে। পিতলের পাতের নকশার জন্য রয়েছে
পুরোনো দিনের ফর্মা। নতুন সময়ে নতুন নতুন নকশারও প্রচলন হচ্ছে। তবে
পুরোনোগুলো দেখতে কিন্তু বেশ সুন্দর। ফর্মা থেকে নকশা তুলে পাত কেটো
ভ্রমর আর ফাইল দিয়ে সেই নকশা ফুটিয়ে তারপর এটি লাগানো হয় ডোল জুড়ে। এর পর
পালিশ। তৈরি হল সেরপাই।
একটা ধাঁধাঁ দেওয়া গেল। এই যে সেরপাইএর ছবি
দেখছেন এই মোটিফটি কোন প্রখ্যাত শিল্পী নিজের বইএর প্রচ্ছদেতে এঁকে ছিলেন?
শান্তিনিকেতনী চামড়ার থলে
এই থলে বা ব্যাগ মেলে শুধুই শান্তিনিকেতনে।
চামড়ার ওপরে কারুকাজ করা এই ঘরণের থলে ভূভারতে মেলা ভাল। চামড়ার থলি বাজারে প্রচুর
রয়েছে। কিন্তু চামড়ার ওপরে মেশিনে চাপ দিয়ে, রং করে তাঁকে নুতন ধরণের চেহারা দেওয়া
শুধুই শান্তিনিকেতনের পক্ষেই সম্ভব। আজ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে আনা বাটিক আর
বাঁধনি এবং বীরভূমের নানান জামাকাপড়ের ওপরে মহিলাদের কাথাঁ ফোঁড়ের কাজের পাশাপাশি
চামড়ার থলে তৈরি আর তার বিপণনের কাজে বহু মানুষ সেখানে জড়িয়ে রয়েছেন।
No comments:
Post a Comment