চন্দনপুরের কাঁসা
দীঘার পথে রামনগর পেরিয়ে ঠিকরা মোড় থেকে ডানহাতি রাস্তা
ধরে বেশ কয়েক কিমি গেলে চন্দনপুর। বাংলার খুব পুরোনো কাঁসা শিল্পের স্থান। এখানে
শিল্পীদের উপাধি রাণা বা মহারাণা। ওডিশায়ও যারা কাঁসার কাজ করেন তাঁদেরও একই
উপাধি। মেদিনীপুর বাংলার ইতিহাসে বহুবার দণ্ডভূক্তিতে ভূক্ত হয়ে ছিল তাঁর দুটি
উদাহরণ আজও চোখে পড়ে কানে বাজে, এই জেলার বাংলা-ওডিয়া-হিন্দি মিশ্রিত ভাষা আর
চন্দনপুরের শিল্পীদের উপাধি।
বহু কাল ধরে চন্দনপুরের শিল্পীদের কাজের সুখ্যাতি সারা
বাংলা ছাড়িয়ে সমগ্র পূর্ব ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু কাল প্রবাহে আজ চন্দনপুরের
কারিগরদের হাঁড়ির হাল। পঞ্চাশ বছর পূর্বে
যে গ্রামে তিনশ পরিবার কাঁসার কাজ করতেন সেই গ্রামে আজ কয়েকটি পরিবার ধুঁকছে। অথচ প্রখ্যাত
শিল্পী কালীপদ রাণা মনে করতে পারেন তাঁর ছোট বয়সে তিনি গ্রামে কত পরিবারকে এই কাজে
যুক্ত থাকতে দেখেছিলেন।
চন্দনপুরের কাঁসার নানান তৈজস তৈরি হলেও আদতে চন্দনপুর-কল্যাণপুরের
খ্যাতি কিন্তু দেবতার মুণ্ড মূর্তির জন্য। বোঝা গেল না? বুঝিয়ে দেওয়া যাক সহজ
জলবত্তরলং করে। আমাদের যাঁদের পরিবারের ঐতিহ্য বেশ পুরোনো, সেই সব পরিবারের পুজোর
ঘরে নিশ্চই দেখেছি শুধু মুণ্ড ধ্যানে পুজিত হন নানান দেবী-দেবতা। যেমন আজকাল খুব
বিকোচ্ছে ছোট্ট কুলোর ওপর শোলার সাজের দুর্গাদেবীর মুখ। ঠিক সেই রকম কাঁসার।
চন্দনপুর-কল্যাণপুরের শিল্পীরা সেই কাঁসার মুণ্ড দেবতাকে
জুড়ে দিয়েছেন একটি ঘটের সঙ্গে। সে এক আলাদা সৌন্দর্য। অপূর্ব সুডৌল কোনও দেবী দেবতার
মুখ যখন জুড়ে যায় পিতলের আরও সুডৌল ঘড়ায় তখন পার্থিব সৌন্দর্য উত্তীর্ণ হয়ে যায়
আপার্থিব এক অলৌকিক মায়াময়তায়।
অথচ বাংলায় কোনও শিল্প মেলায় রাণাদের শিল্পকর্মর দেখা
মেলেনা। এদের কোনও শিল্পকর্ম কোনও সরকারি বেসরকারি আপণে নেই। নেই মুখ্যমন্ত্রীর
সাধের বিশ্ববাংলা প্রকল্পেও – যদিও সেখানে মাত্র বাংলার কয়েক শত গ্রাম শিল্প
উৎপাদনের মাত্র দশটার কাছাকাছি নিয়েছেন – আমরা এই প্রবন্ধে প্রশ্ন তুলছি না সরকার
কী এনজিওদের মত বেছে বেছে কাজ করতে পারেন? সুযোগ পেলে সে প্রশ্ন-উত্তর খেলা
বারান্তরে করা যাবে – এখন এদের সমস্যার উত্তর খুঁজি।
আমরা জানিনা বাংলার গ্রাম শিল্প রসিক কয়জন এঁদের কাজের নাম শুনেছেন। রোজ
কয়েক হাজার মানুষ দীঘা যান, ট্রেনে বাসে নিজের মোটর গাড়িতে রামগরের ওপর দিয়ে। এঁদের মধ্যে অনেকেই
গ্রাম শিল্প রসিক। এঁদের মধ্যে বেশ কিছু মানুষ স্ব-ইচ্ছায় গ্রামশিল্পের পৃষ্ঠপোষণা
করেন, অন্যকে উতসাহিত করেন। কিন্তু রং রুটকে প্রস্তাব, একটা সুমারী করে দেখাই যেতে
পারে এই দীঘা যাত্রী উৎসাহীদের মধ্যে কজন ঐতিহ্যবাহী চন্দনপুরের শিল্প কর্মের নাম
শুনেছেন, কাজ দেখাতো দূরস্থান। তাহলে হয়ত নতুন কিছু উপাত্ত বেরোলেও বেরোতে পারে।
No comments:
Post a Comment