নতুনগ্রামের কাঠের কাজ
এই গ্রামে যাওয়া যায় হাওড়া কাটোয়া রেলরাস্তায় পাটুলি বা
দাঁইহাঈ স্টেশন থেকে। নতুন গ্রাম বিখ্যাত তাঁর কাঠের প্যাঁচা, রাধাকৃষ্ণ, ইত্যাদি।
বহু গবেষক যাঁরা বিশ্বাস করেন না, এ দেশে কোনও কিছু নিজস্ব তৈরি হতে পারে বিদেশী
প্রভাব ছাড়া, এগুলিকে মমি পুতুল আখ্যা
দিয়েছেন – তাদের ধারণা ছিল এগুলি মিশর দেশ প্রভাবিত। কেনন এর আকার প্রায় তিন কোণা,
প্রায় মিশরের মমির মত।
বাংলার পুতুল বিষয়ে একটি দীর্ঘ লেখা তৈরি করতে গিরে প্রয়াত গবেষক,
রঘুনাথ গোস্বামীর সহযাত্রী, তারাপদ
সাঁতরা নতুনগ্রামের পুতুলের
বিলুপ্তির আশঙ্কার কথা উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর গবেষণাপত্রে তিনি লিখেছিলেন, ‘অধুনা বিলুপ্ত কালীঘাটের কাঠের পুতুলের সঙ্গে নতুন গ্রামের
পুতুলের বেশ কিছু সাদৃশ্য রয়েছে।’ অর্থাৎ কালীঘাটের পুতুল হারিয়ে গিয়েছে কালের গর্ভে, হয়ত নতুনগ্রামের
পুতুলটিও বিলয় প্রাপ্তি ঘটবে, বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
তাঁর আশংকা সত্যি করে কিন্তু নতুনগ্রামের পুতুলও মরে নি,
শিল্পীরাও নতুন জীবন পেয়েছেন পুতুলকে নানান আসবাবে ব্যবহার করে। এক কালে পুতুলের
চাহিদা যখন কমে গেল তখন কছু মানুষ, তাঁর মধ্যে প্রয়াত রঘুনাথ গোস্বামীও ছিলেন, এই
শিল্পের মানুষদের নতুন এক উষায় বাঁচিয়ে তুলতে খুব খেটেছিলেন। হাইকোর্ট পাড়ায় তাঁর
বিজ্ঞাপন কোম্পানির দপ্তরে সেই ৯৩, ৯৪ সালে দেখেছিলাম নতুন ধরণের নকশা তুলছেন
কাগজে যাতে শিল্পীরা সেগুলো রূপায়ণ করতে পারেন – তখন আমরা কয়েকজন তাঁর সঙ্গে সঙ্গ
করছি। তিনি মারা যান তার কয়েক বছরের মধ্যেই। তিনি যে ফল ফলাতে চেয়েছিলেন সেই কাজটি তিনি দেখে
যেতে পারেন নি। আজ কিন্তু পুতুলের
জন্য বিখ্যাত বর্ধমান জেলার নতুনগ্রামের
বহু শিল্পী আসবাবপত্র করে বেঁচে গিয়েছে।
তারাপদবাবুর সত্যি আশংকা মিথ্যে করে আজও নতুন গ্রামের
প্যাঁচা বহাল তবিয়তে বিক্রি হচ্ছে মেলায় মেলায় এমনকি কলকাতার গর্বিত বুটিকেও। আসবাবপত্রে ফুটিয়ে তোলা হতে
থাকে রাজা-রানি, রাধা-কৃষ্ণ, কিংবা পেঁচার অবয়ব। তার উপর দেওয়া হয় উজ্জ্বল রঙের
প্রলেপ।
বর্ধমানের নতুনগ্রাম, দাঁইহাট, পাটুলি, কাষ্ঠশালী সব জায়গায় এখন
কাঠের প্যাঁচা সারা বছর জেগে থাকে - রংদার হুতুম,গম্ভীর হুতুম, দায়িত্বশীল হুতুম,নিরীহ হুতুম,বেচারা হুতুম হাজার প্রকার তার ভাবভঙ্গি৷ কলকাতার ঘরে ঘরে কাঠের প্যাঁচার
কদর হয়েছে৷ তার গোল গোল চোখ, রঙিন নকশার ডানা সব কিছু নিয়ে সেও বড় আদরের বাহনবাবু৷ ওদিকে দশকর্মার দোকানেও প্যাঁচা পাওয়া
যায়৷ তার আবার গায়ের রং লাল৷ পুজোর সময় তাকে বসতে হবে মায়ের আসনে৷ সে আবার অত
গোলগাল নয়৷ তার আবার চেহারা লম্বাটে৷ সব মিলিয়ে এখন প্যাঁচার বাজার বেড়ে চলেছে শুধু কলকাতায় নয় জেলাতেও৷
ইদানীং
কালে থিম পুজোর দৌলতেও নতুনগ্রামের কাঠের পুতুলের কিছুটা হলেও
রমরমা বেড়েছে। কখনও পেঁচার আকারে মণ্ডপ, কখনও বা পুতুলের আকারে দুর্গা প্রতিমা। শহুরে নাগরিকের কাছে
নতুনগ্রামের কাজের চাহিদা তুঙ্গে। বাঙালির বসার ঘরে এই ধরণের
আসবাব বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছে। আর দামও খুব একটা বেশি নয়। সাধারণ সোফা সেটের
দামই পড়ে যায় কুড়ি হাজার টাকার কাছা কাছি, তখন দুটো একসঙ্গে তিন জনের বসার চেয়ার,
দুটো এক জনে বসার চেয়ার একটা টিপয়ের দাম এই বাজারে হাজার পনের টাকা। আসবাবে নানান
ধরণের রঙের ব্যবহার বাঙালির বসার বা শোয়ার ঘরে যে নতুন ধরণের শিল্প শৈলীর ছোঁয়া
দিয়েছে, নতুন পরিচয় দিয়েছে পরিবারকে সে কথা অস্বীকার করা যায় না।
এর ফলে প্রায় লুপ্ত হবার থেকে বেঁচে গিয়েছে বহু শিল্পী
পরিবার। আজও সেই গ্রামগুলি গেলে, মানুষগুলিকে নিরন্তর কাজ করতে দেখলে, প্রয়াত নীরব
এক দূরদৃষ্টি সম্পন্ন শিল্পপৃষ্ঠপোষক রঘুনাথ গোস্বামীর চেষ্টার কথা, শিল্পের প্রতি
তাঁর ভালবাসার কথা বার বার মনে পড়ে। তাঁর হাত ধরে বাংলার শিল্প বহুনবার সাগর পাড়ি
দিয়েছে – কখনও রাশিয়া, কখনও আমেরিকা, কখনও ইওরোপের কোনও দেশ। তিনি বিলাসবহুর
পাঁচতারা সরাইএর সাগ গোজের পরিকল্পনা করতে বাংলার আলপনা যেভাবে ব্যবহার করেছিলেন,
তার শুধু ব্যতিক্রমীই নয়, নয়নভিরামীও বটে। তাঁর কাজ নতুন পথ দেখাবার কাজ করেছিল,
কিন্তু তাঁর কোনও উত্তরাধিকারী হল না।
আদতে ইতিহাস প্রমাণ কখনও কখনও একজন মানুষের প্রচেষ্টা
পাল্টে দিতে পারে একটি সম্প্রদায়ের জীবন, থামিয়ে দিতে পারে বিশ্বায়নের লুঠেরা রথ,
সেই অন্তত বেশ কয়েকটি কাজ আজও গ্রাম বাংলার অর্থনীতি, ঐতিহ্য, পরম্পরাকে বাঁচিয়ে
রাখার রঘুনাথবাবুর কাজ অন্তত সক্কলে ভুলে গেলেও কিছু মানুষের মনে থেকে যাবেন
চিরকাল।
No comments:
Post a Comment