জয়নগরের শোলা
শোলা
শিল্পের ভবিষ্যৎ আছে – অন্তত ২৪ পরগণার জয়নগর
প্রান্তে। এই ব্যবসা ক্রমশই গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে। এই
অল্পপুঁজির শিল্পের ইতিবাচক বিশেষ দিকটি হল এই শিল্পে দূষণ নেই। এটি একটি কৃষি
ভিত্তিক শিল্প। শুধু শিল্প নয়, শোলার চাষও দক্ষিণ ২৪ পরগণার কিছু অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। শোলা
গাছ জলা জায়গায় বেশি হয়।
বাংলাদেশ বা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলে বনগাঁ,
হাবড়া, বসিরহাট, কল্যানীর দিকে
জলা জায়গায় যে শোলা হয় সেগুলি মোটা, বড়ো, নরম ও তাজা হয়। ওইগুলিই সেরা জাতের শোলা। চাষ হত ওই
সব অঞ্চলে, তবে
বাজার বসত হাওড়ায়। শিল্পীরা আগেই হাওড়া থেকে শোলা গাছ কিনে
আনতেন। দক্ষিণ ২৪ পরগণার এই অঞ্চলে মন্দিরবাজার থানার মহেশপুর গ্রামেই প্রথম শোলার
কাজ আরম্ভ হয়। আনুমানিক দু'শ বছর
আগে।
আনুমানিক ১০০ বছর আগে মোকিমপুরে
ও ৪০-৫০ বছর আগে পুকুরিয়ায় শুরু হয়।
মহেশপুরের ১০০ শতাংশ ও পুকুরিয়ার ৯৯ শতাংশ পরিবার এই শোলার কাজ করে। এছাড়াও হাটতলা, গোকুলনগর, সুঁদির হাট, কালিতলা, গোপালনগর
প্রভৃতি গ্রামে কাজ হচ্ছে। শোলার শিল্পদ্রব্য মাদ্রাজের তুতিকোরিন বন্দর দিয়ে
জাহাজে কন্টেনারে ভরে বিদেশে রপ্তানি হয়। আগে শোলা শিল্পীরা টোপর, কল্কা, ঠাকুরের গহনা, কদমফুল, চাঁদমালা
ইত্যাদি তৈরি করত।
ফুলের কাজ প্রথম শুরু করেন
মোকিমপুরের মন্টু গায়েন ও মহেশপুরের ভীষ্ম কয়াল। তারপর অন্যরাও করতে থাকে। শোলার
দর্শনীয় গোলাপ বা চন্দ্রমল্লিকা এই মন্দিরবাজার থানার কিছু গ্রাম ছাড়া কোথাও হয়না।
যদিও দক্ষিণ ২৪ পরগণারই শিরাকোল, আমতলা, বারুইপুর প্রভৃতি অঞ্চলেও শোলার কাজ হচ্ছে। আর এখন এই
পুকুরিয়া হাটে প্রতি শনিবার সকাল পাঁচটা থেকে ৮/৯ টা অবধি শোলার শিল্প সামগ্রি কেনা বেচা হয়। জয়নগর ও মগরাহাট থানার বাঁকার
দাঁড়, ঈশ্বরীপুর প্রভৃতি গ্রাম থেকে হিন্দু ও মুসলিম চাষিরা শোলা
গাছ আনে এখানে বিক্রি করতে।
শোলা গাছের বান্ডিলকে আঞ্চলিক
ভাষায় 'তারি' বলে। এক তারি-তে আট-দশ বা
পনেরো পিস শোলা গাছ থাকতে পারে। এক তারি সরু শোলা গাছের দাম ৪ টাকা হতে পারে,
আবার ভালো শোলা হলে তার দাম ২০ টাকাও হতে পারে। শোলা শিল্প সামগ্রী তৈরিতে
লাগে সাদা সূতো, ফেভিকল, আঠা, হলুদ, লাল, সবুজ, ব্রাউন ইত্যাদি
আট দশ রকমের রাসায়নিক রঙ। সরঞ্জাম বা হাতিয়ার হিসেবে লাগে ১)
কাতি -- দুরকমের শোলা পাতা কাটার জন্য। ২) ডিজাইন ছুরি ছয় সাত রকমের। ৩) বাটালি (ছোটো) তিন রকমের। এছাড়াও লাগে কাগজ কাটার
জন্য কাঁচি।
এই অঞ্চলের শোলার কাজ প্রথম শুরু
হয় মহেশপুর গ্রামের মালি পাড়ায়। প্রকৃতপক্ষে এটি হালদারপাড়া, সবার পদবী
হালদার। কিন্তু যেহেতু প্রতিমার শোলার চাঁদমালা ইত্যাদি তৈরি করেন সেই অর্থে তারা
মালাকার বা মালি। তাঁরা শোলার মুকুট, টোপর, ঠাকুরের গয়না করেন। তাঁদের মালা
যায় কুমোরটুলি, বড়োবাজার
প্রভৃতি অঞ্চলে। যায় কাকদ্বীপ, ডায়মন্ড হারবারেও। কুমোরটুলি থেকে বোম্বে দিল্লী যায় তাদের
তৈরি শোলার দ্রব্য। আনেকের হাতের কাজ আমেরিকা পর্যন্ত যায়।
এই শিল্পের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। আগের থেকে অনেক বেশি লোক যুক্ত হয়েছে এই শিল্পে।
বাঁশবেড়িয়া, মৌখালি, হাটতলা, রাঙাবেড়িয়া, চৈতন্যপুর, মূলদিয়া
ইত্যাদি গ্রামেও হচ্ছে এই কাজ। আমেরিকা, হংকং, সিঙ্গাপুরে মাদ্রাজ দিয়ে রপ্তানি হয়। প্রায় ২০-২৫ টি গ্রামের আনুমানিক হাজার
কুড়ি মানুষ এই শোলা শিল্পে নিযুক্ত আছেন। এবং মাসে প্রায় ১৫ থেকে ২০ লক্ষ টাকার কেনাবেচা হয় এই গ্রামগুলিতে।
সিনেমায় ডেকরেশন, গৃহ
বা আঙিনা সজ্জার কাজে শোলার সামগ্রীর দারুন চাহিদা এমনকি বিদেশেও। ১৫-১৬ বছর ধরে এই শোলার সামগ্রীর রমরমা
চলছে। তবে বর্তমানে নকল প্লাস্টিকের তৈরি ফুল কিছুটা বাজার দখল করেছে। কিছুটা
খেজুরপাতা, তালপাতা থেকে প্রস্তুত ঘর সাজাবার
জিনিসও বাজারে জায়গা নিয়েছে। মহেশপুর গ্রাম তথা মন্দিরবাজার থানায় ৫ শতাংশ বাজার
এসবের দখলে। দক্ষিণ বারাসাত অঞ্চলের গোঁড়ের হাট এলাকায় খেজুর পাতা ইত্যাদির
প্রাকৃতিক জিনিস ভালো তৈরি হচ্ছে, জানালেন সুব্রত হালদার।
রাসযাত্রার সময়, এটা জয়নগর মজিলপুরে বোঝা যায় রাসযাত্রার দু-তিনদিন আগে থেকে। যখন
মজিলপুর দত্তবাজারে শোলার কদমফুল পাখি নিয়ে শোলাশিল্পীরা বিক্রি করতে আসে। আর
বাজারের ভর্তি তলির সাথে ফুল, পাখি হাতে লোকেদের বাড়ি ফিরতে দেখা যায়। রাসের সঙ্গে শোলার কদমফুল, কাকাতুয়া, টিয়ার সম্পর্ক কতদিনের সে কথা বলে গিয়েছেন সুধাংশু কুমার রায় ১৯৫১ সালে দ্য
আর্টিজান কাস্ট অব ওয়েস্টবেঙ্গল এন্ড দেয়ার ক্রাফট গবেষণায়।(বেশ কিছু তথ্য মন্থন সাময়িকী থেকে নেওয়া)
No comments:
Post a Comment