বিষ্ণুপুর
মল্ল রাজাদের পীঠস্থান। বাংলার কারিগরী শিল্প আর
নিজস্ব প্রযুক্তি বলতে যা বোঝায়, তাঁর একটা বড় অংশ আজও ধারণ করে রয়েছে বিষ্ণুপুর।
বৈষ্ণব চর্চার পীঠস্থান, বাংলার মাটির বাড়ি যে এত্ত সুন্দর এত্ত ভাষ্কর্যময় আর
এত্ত দিন টিকে থাকতে পারে বিষ্ণুপুরের মন্দিরগুলো না দেখলে বোঝা যায় না। শুধু
বিষ্ণুপুরই নয়, রাঢ় বাংলার গ্রামের বাড়ির বাঁকানো চাল আর দেওয়ালে দেওয়ালে
নয়নাভিরাম পঙ্খের, আলপনার কাজ দেখে ভাবনা শুন্য হয়ে, সব কিছু চুরি করে নিজের করে
নেওয়া পরম্পরা ঐতিহ্য সংস্কৃতিহীন ব্রিটিশরা নিজেদের বাড়ির আন্য নাম না দিয়ে নাম
দিল বাংলো বা বাংলা আঙ্গিকের বাড়ি! আজ ঔপনিবেশিক কর্তারা কোনও কিছু না ভেবেই,
বাংলার স্থাপত্য ভুলে ইওরোপের গথিক আঙ্গিক নকল করছেন। বিষ্ণুপুরের মাটির মন্দির
বিষয়ে প্রচুর বাক্য, মেধা খরচ হয়েছে, ফলে সেই পথে না হেঁটে আমরা বিষ্ণুপুর
পরিভ্রমণ শুরু করব দশাবতার তাস দিয়ে।
দশাবতার তাস
আমি মন্দিরের রাস্তায় না গিয়ে পরিচয় করাব এক নতুন
শিল্পকর্ম দশাবতার তাস বিষয়ে। সাধারণ প্রচলিত ভারতীয় ইতিহাস বলছে পর্তুগিজদের হাত ধরে ভারতে তাস খেলার উদ্ভব। কিন্তু বিষ্ণুপুরের ইতিহাস বলছে মল্লরাজাদের সমৃদ্ধিকালে দশাবতার তাস আর তাস খেলার প্রবর্তন হয়। হরপ্রসাদ
শাস্ত্রী মশাই ১৮৯৫ সালের এসিয়াটিক সোসাইটির জার্নালের এক ছোট্ট নোটে বলছেন ...I
fully believe that the game was invented about eleven or twelve hundred years
before the present date. শাস্ত্রী মশাই-এর
হিসেব অনুযায়ী এই খেলার উদ্ভব সপ্তম-অষ্টম শতক।
প্রথম কারণ সাধারণতঃ প্রচলিত দশাবতার বিশ্বাসে জগন্নাথ বা বুদ্ধের স্থান নবম – কল্কীর(স্মরণ
করুন কবি কোকিল জয়দেবের দশাবতার শ্লোকাবলী - প্রলয় প্রলয়ধি
জলে-র বুদ্ধসংক্রান্ত শ্লোকটি) আগে।
কিন্তু দশাবতার তাস অনুযায়ী জগন্নাথ বা বুদ্ধদেবের স্থান পঞ্চম। শাস্ত্রীমশাইএর
যুক্তি ধরে বলা যায়, বাংলায়
এমন এক সময়ে দশাবতার তাস খেলার প্রবর্তন হয়েছিল, যখন
বুদ্ধদেব পঞ্চম অবতার রূপে গণ্য। তাসে বুদ্ধমুর্তি আদতে জগন্নাথ মূর্তি, - কেবল
মাথা ও হাতসহ দেহকাণ্ডের মূর্তি। সুতরাং জীবের ক্রমবিকাশেরস্তরে নৃসিংহ(অর্ধ
নর অর্ধ পশু) এবং বামনের (পূর্ণ
নর) মধ্যবর্তী স্থান পেয়েছেন তিনি - অর্থাত্
নিম্নতম জীব মত্স্য থেকে পূর্ণ মানব পর্যন্ত বিকাশের ইতিহাসের একদম মাঝখানটি
অধিকার করে আছেন তিনি।
তাই বিনয় ঘোষবাবু এটিকে বলছেন ...খুব
যুক্তিসংগত স্থান। আর ভারতীয় চিহ্ণতত্বের বিকাশের দৃয্টিভঙ্গী হিসেবে যদি দেখা যায়, দশাবতার
তাসে বুদ্ধের প্রতীক পদ্ম। অর্থাত্ এই তাসটি এমন সময় প্রতিভাত হয় যখন বুদ্ধ
পদ্মপাণিরূপে পরিচরত ছিলেন - অর্থাত্ পদ্মই
ছিল তাঁর পুজোর প্রতীক - যে সময়ের বাংলার কথা আমরা আলোচনা করছি
সেটি হল মহাযানী বাংলার কাল। ৮০০ থেকে ১০০০ খ্রীষ্টাব্দের সময় - পাল
রাজত্বে বা তার কিছু আগেও হতে পারে। জয়দেব বা ক্ষেমেন্দ্রর কালে প্রচলিত ধারার
উত্পত্তি হলেও পাল রাজাদের আগেও এই দশাবতার তাস খেলার প্রচলন ছিল।
No comments:
Post a Comment